ধর্ষণে অভিযুক্ত বাঁকুড়া মেডিক্যালের হাউসস্টাফ
শারীরিক পরীক্ষার নামে ওয়ার্ডের মধ্যেই মূক ও বধির তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠল এক হাউসস্টাফের বিরুদ্ধে। সোমবার রাতে বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ‘ফিমেল মেডিসিন’ ওয়ার্ডে ওই ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করে মঙ্গলবার সকালে হাসপাতাল সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন তরুণীর বাবা। সন্ধ্যায় পুলিশের কাছেও ওই মর্মে এফআইআর করা হয়েছে।
এই অভিযোগকে ঘিরে মঙ্গলবার দিনভর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর, এবং পুলিশের কথায় একাধিক অসঙ্গতি ও পরস্পরবিরোধিতা সামনে এসেছে। ওই তরুণীর পরিবারের বক্তব্যের সঙ্গে নানাবিধ ফারাক তৈরি হওয়ায় ধোঁয়াশা বেড়েছে। রাতে অভিযুক্ত হাউসস্টাফকে হাসপাতালে ডেকে পাঠায় পুলিশ। সুপারের ঘরে তাঁর সঙ্গে কথা বলেন পুলিশ সুপার প্রণব কুমার এবং স্বাস্থ্য ভবনের দুই তদন্তকারী মহিলা অফিসার। রাত এগারোটা নাগাদ তাঁকে ‘নির্যাতিতা’ রোগিণীর ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে পুলিশ সুপার বলেন, “বিষয়টি অত্যন্ত সংবেদনশীল। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলব না।”
হাসপাতাল সুপারকে দেওয়া ধর্ষিতার বাবার অভিযোগপত্রের প্রতিলিপি।
কী অভিযোগ করেছে তরুণীর পরিবার? জানা গিয়েছে, রবিবার বুকে ব্যথা হওয়ায় ওই তরুণী প্রথমে শালতোড়া ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি হয়েছিলেন। সেখান থেকে ‘রেফার’ হয়ে সোমবার দুপুর ১টা নাগাদ বাঁকুড়া মেডিক্যালের তিন তলায় ফিমেল মেডিক্যাল ওয়ার্ডে ভর্তি করানো হয় তাঁকে। তরুণীর মায়ের অভিযোগ, “রাত ১১টা নাগাদ এক ডাক্তারবাবু এসে আমাদের ঘুম থেকে তুলে বলেন, মেয়েকে পরীক্ষার জন্য পাশের ‘রুমে’ নিয়ে যাবেন। আমি বলি, দুপুরেই তো পরীক্ষা হয়েছে। এত রাতে আবার কীসের পরীক্ষা? ডাক্তারবাবু তবু মেয়েকে নিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন। অনেক ক্ষণ পরেও মেয়ে না বেরনোয় দরজার ফাঁক দিয়ে দেখি, ও বিছানায় শুয়ে। গায়ে কাপড়জামা নেই।”
ওই মহিলার দাবি, তিনি তখন ওয়ার্ডের নার্সদের ডাকাডাকি করেন। তাঁরা দূরে রোগী দেখতে ব্যস্ত থাকায় তাঁর কথা শুনতে পাননি। এর পরে তিনি জোরে দরজায় ধাক্কা মারতে সেটি খুলে যায়। তাঁর বক্তব্য, “ভিতরে মেয়ে ‘গাঁ গাঁ’ আওয়াজ করে কাঁদছিল। আমাকে দেখেই কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করতে থাকে। পরে ইঙ্গিতে বোঝায়, ওর সঙ্গে নোংরামি করা হয়েছে। আমি তখন ডাক্তারকে বলি, মেয়েকে বিবস্ত্র করেকী চিকিৎসা করছেন? ডাক্তার বলেন, এটা এক ধরনের পরীক্ষা। আমি বলি, আপনি কোনও খারাপ কাজ করছিলেন। তখন ডাক্তার হুমকি দেন, ‘বেশি চেঁচাবেন না। মেয়েকে হাসপাতাল থেকে ছুটি করে দেব’। এর পরেই উনি ওয়ার্ড ছেড়ে চলে যান।”
সোমবার রাতেই তরুণীর মা অন্য রোগিণীদের জড়ো করে সব জানিয়েছিলেন। ওই তরুণীর পাশের শয্যায় রয়েছেন রোগিণী রেখা মণ্ডল। রেখাদেবীকে মঙ্গলবার সকালে দেখতে আসেন তাঁর স্বামী, পুরুলিয়ার বাসিন্দা বিশ্বনাথ মণ্ডল। রেখাদেবী তখন স্বামীকে আগের রাতের ঘটনার কথা জানান। বিশ্বনাথবাবু ওই তরুণীর বাবাকে নিয়ে প্রথমে স্থানীয় ক্লাবে যান। তার পর দেখা করেন স্থানীয় তৃণমূল নেত্রী প্রতিমা বিশ্বাসের সঙ্গে। প্রতিমাদেবীই তাঁদের লিখিত অভিযোগ করার পরামর্শ দেন।
সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ হাসপাতাল সুপারকে লিখিত অভিযোগ করা হয়। সাক্ষী হিসাবে বিশ্বনাথবাবুও সই করেন। ঘটনা চাউর হতে অন্য রোগীর আত্মীয়-পরিজনরাও সুপারের ঘরের বাইরে বিক্ষোভ দেখান। তাঁরা মহিলা ওয়ার্ডে সোমবার রাতে ডিউটিতে থাকা সব হাউসস্টাফকে ডেকে ওই তরুণীকে দিয়ে শনাক্তকরণের দাবি তোলেন। যদিও সুপার তাতে আমল দেননি বলে অভিযোগ। বিশ্বনাথবাবুর বক্তব্য, “এ দিন সকালেও ওই হাউসস্টাফ ওয়ার্ডে এসেছিলেন। তখন মেয়েটি ওঁর দিকে আঙুল তুলে আমাকে ইশারা করে। তার পরেও সুপার কেন ডিউটিতে থাকা ডাক্তারদের ডেকে পাঠালেন না, জানি না। এর থেকেই স্পষ্ট, হাসপাতাল ঘটনাটা ধামাচাপা দিতে চাইছে।” বাঁকুড়া থানার এক অফিসারও বলেন, “আমরা বুঝতে পারছি না, কেন সুপার ওই ডাক্তারকে ডেকে শনাক্তকরণ করালেন না।”
অভিযোগ পাওয়ার পরে হাসপাতাল সুপার পঞ্চানন কুন্ডু তা হলে কী করলেন? হাসপাতালের তরফে চার সদস্যের একটি তদন্তকারী দল গড়া হয়, যার নেতৃত্বে রয়েছেন ফরেন্সিক বিভাগের প্রধান সুপর্ণা দত্ত। আছেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ দেবযানী দেব, মেডিসিনের মিতালি বসু এবং নার্সিং সুপার দীপালি নাগ। সোমবার রাতে পুরুষ-মহিলা মিলিয়ে মোট ৯ জন ডিউটিতে ছিলেন। চিকিৎসক মিতালি বসু ও শুকদেব দাসের ইউনিট ছিল। তাতে ছিলেন ছ’জন (দু’জন করে পিজিটি, হাউসস্টাফ ও ইন্টার্ন)। এঁদের মধ্যে এক জনই মহিলা। রাত ১০টার পরে অন্য ইউনিটের আরও তিন জন এই ওয়ার্ডে ডিউটিতে যান। এই ৯ জনের প্রত্যেকের সঙ্গেই তদন্তকারী দল কথা বলেছে। হাসপাতালের সুপার এ দিন দুপুর ২টো নাগাদ বলেন, “ধর্ষণ হয়েছে কি না, এখনই বলা সম্ভব নয়। তবে শ্লীলতাহানি হয়েছে বলে প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে। মেয়েটির ডাক্তারি পরীক্ষা হয়েছে। অভিযুক্ত হাউসস্টাফকে আপাতত ডিউটিতে আসতে বারণ করা হয়েছে।” সুপার স্বীকার করেন, “হাসপাতালের তদন্তে এটা প্রমাণিত যে, সোমবার রাতে কোনও মহিলা স্বাস্থ্যকর্মী বা মেয়েটির মায়ের উপস্থিতি ছাড়াই ওই হাউসস্টাফ মেয়েটিকে শারীরিক পরীক্ষা করার জন্য আলাদা ঘরে নিয়ে যান। এটা গর্হিত অপরাধ।”
সুপার এ কথা বলার ঘণ্টা দুয়েক পরেই অবশ্য সম্পূর্ণ উল্টো কথা বলেন হাসপাতালের তদন্তকারীরা। সুপর্ণাদেবী ও মিতালিদেবীর দাবি, “ফিমেল মেডিসিন ওয়ার্ডে এমন কোনও আলাদা ঘর নেই, যেখানে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। তবে ওয়ার্ডের একপাশে কাঠের পার্টিশন আছে। কোনও দরজা নেই। সেখানে আছে ইসিজি মেশিন ও শয্যা। মেশিনটি তিন মাস হল বিকল। তা হলে ওই ঘরে কোনও রোগিণীকে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করার প্রশ্নই ওঠে না!” অথচ এ দিন কিন্তু ওই ওয়ার্ডটি ঘুরে স্পষ্টই দেখা গিয়েছে, পার্টিশনের ভিতরে একটি এক পাল্লার দরজা রয়েছে। তাতে ছিটকিনিও আছে। ঘরটি যথেষ্ট বড় এবং একাধিক শয্যা সেখানে রয়েছে।
সুপার নিজে ‘গর্হিত অপরাধে’র কথা স্বীকার করেও লিখিত অভিযোগপত্রটি কিন্তু সারা দিনে পুলিশকে পাঠাননি। বাঁকুড়া সদর থানার আইসি প্রভাত সরকার নিজে দুপুর তিনটে নাগাদ সুপারের কাছে গিয়ে অভিযোগপত্রটি দিতে অনুরোধ করেন। সুপার তাঁকে অপেক্ষা করতে বলে বেরিয়ে যান। আধঘণ্টা পরেও সুপার না ফেরায় ধৈর্য হারিয়ে আইসি থানায় চলে যান। দিনভর আর সুপারকে তাঁর ঘরে দেখা যায়নি। তিনি ফোনও ধরেননি। জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, “হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অভিযোগপত্রটি আমাদের কাছে ‘ফরওয়ার্ড’ করে দিলেই কাজ হয়ে যেত। সেটাকেই এফআইআর হিসাবে গ্রহণ করে তদন্ত শুরু করতে পারতাম। কিন্তু পুলিশ অফিসারেরা বারবার বলার পরেও হাসপাতালের সুপার তা করেননি।”
শেষ পর্যন্ত এ দিন সন্ধ্যায় ওই তরুণীর বাবা বিশ্বনাথবাবুকে সঙ্গে নিয়ে থানায় গিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করেন। সন্ধ্যায় এফআইআর হওয়ার পরে বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার প্রণব কুমার বলেন, “ধর্ষণের অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু হয়েছে।” রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ তিনি ও অতিরিক্ত এসপি-কে নিয়ে হাসপাতালে যান তদন্তে। তাঁরা ওই তরুণী এবং তাঁর বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলেন।
এই ঘটনার কথা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ দিন দুপুর পর্যন্ত রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরকেও জানাননি। স্বাস্থ্য সচিব সঞ্জয় মিত্র নিজস্ব সূত্রে খবর পেয়ে ওই রোগিণীর ডাক্তারি পরীক্ষা করানোর নির্দেশ দেন সুপারকে। পরে ঘটনার তদন্তে সরকারি দল পাঠানোর সিদ্ধান্তও নেন স্বাস্থ্য সচিব। স্বাস্থ্যভবন থেকে কণিকা মান্ডি ও মহুয়া বন্দ্যোপাধ্যায় নামে দুই অফিসার রাতে পৌঁছন বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য মঙ্গলবার বিকেলে বলেন, “স্ত্রীরোগ বিভাগের চিকিৎসকেরা প্রাথমিক ভাবে মেয়েটিকে পরীক্ষা করে ধর্ষণের কোনও চিহ্ন পাননি। আমাদের কাছে যা রিপোর্ট, সোমবার রাতে মহিলা চিকিৎসকের অনুপস্থিতিতে মেয়েটিকে কোনও রকম পরীক্ষার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়নি। মেয়েটি মূক কি না, সে নিয়েও সংশয় রয়েছে।” অথচ বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজেরই অধ্যক্ষ মনোজ চৌধুরী জানিয়েছেন, মেয়েটি মূক ও বধির। ওই তরুণীর মা-বাবা’র কথায়, “জন্ম থেকেই আমাদের মেয়ে কানে শুনতে পায় না। কথাও বলতে পারে না।” একই কথা বলছে পুলিশও। এ দিন রাতে এসপি বলেন, “মেয়েটি কথা বলতে পারে না।”
স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তার মতো সুপর্ণাদেবীরও দাবি, ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণের প্রমাণ মেলেনি। সুপার ‘শ্লীলতাহানি’র কথা ইঙ্গিত করলেও সুপর্ণাদেবী সে কথা বলেননি। বরং গোটা ঘটনাটির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, “মেয়েটিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আমাদের মনে হয়েছে, তার ‘অ্যাংজাইটি নিউরোসিস’ বা ‘স্কিৎজোফ্রেনিয়া’ আছে। তার মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে। এ-ও জানা গিয়েছে, সোমবার রাত ৯টা নাগাদ তাকে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছিল। সেই অবস্থায় সে তার বাড়ির লোকেদের আকার-ইঙ্গিতে যা বলতে চেয়েছে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়।” তা হলে মেয়েটিকে বিবস্ত্র অবস্থা কেন পাওয়া গেল? তদন্তকারী দলের বক্তব্য, এর কোনও প্রমাণ মেলেনি। মেয়েটির মা বা প্রত্যক্ষদর্শীরা কি তাহলে মিথ্যা বলছেন? জবাব পাওয়া যায়নি।
তরুণীর মা বলেন, “এই হাসপাতালেই কত বার মেয়েকে নিয়ে এসেছি। আগে তো কোনও ডাক্তার মেয়ের মানসিক অসুস্থতা নিয়ে কিছু বলেননি। আজ হঠাৎ কেন এ কথা বলা হচ্ছে, বুঝতে পারছি না।” তাঁর আশঙ্কা, মেয়েকে ‘পাগল’ প্রতিপন্ন করে আসল ঘটনা আড়াল করার চেষ্টা চলছে। স্থানীয় তৃণমূলনেত্রী প্রতিমাদেবীর বক্তব্য, “এই ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না। তদন্ত হওয়া দরকার। এই হাসপাতালে আগেও নানা খারাপ ঘটনা ঘটেছে। সব ক্ষেত্রে লিখিত অভিযোগ হয়নি।”
কোথায় অসঙ্গতি
স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তার দাবি, তরুণী মূক নন।
বাঁকুড়া মেডিক্যালের অধ্যক্ষ ও বাবা-মা বলছেন, মেয়েটি মূক।

নিজস্ব চিত্র
‘ধর্ষণের’ ঘরে দরজা নেই, দাবি হাসপাতাল তদন্ত কমিটির।
আনন্দবাজারের প্রতিবেদক ও আলোকচিত্রী ঘরে এক পাল্লার দরজা দেখেছেন। ছিটকিনিও আছে।
তদন্ত-কমিটি মেয়েটির মানসিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
মা-বাবা বলেছেন, সে মানসিক ভাবে সুস্থ।
মা এবং এক রোগিণীর দাবি, মেয়েটিকে নগ্ন অবস্থায় পাওয়া যায়।
• তদন্ত-কমিটির দাবি, প্রমাণ মেলেনি।
• সকালে সুপার বলেন, তরুণীকে ‘পরীক্ষা’র সময়ে ঘরে মহিলা স্বাস্থ্যকর্মী ছিলেন না।
• বিকেলে স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তার দাবি, মহিলা চিকিৎসক ছিলেন।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.