কেউ কথা রাখেনি! কেউ কথা রাখে না! ফের প্রমাণ করল মঙ্গলবারের ধর্মঘট!
তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণা ছিল, ধর্মঘট-বিরোধিতায় তাঁদের দলের কেউ রাস্তায় নামবে না। প্রশাসন সক্রিয় থাকবে রাজ্যকে সচল রাখতে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, ধর্মঘটকারীদের উপরে হামলার অভিযোগ এল প্রধান শাসক দলের বিরুদ্ধে। জোর করে দোকানপাট খোলানোর চেষ্টা হল। খাস কলকাতাতেই যাদবপুরে সিপিএমের কার্যালয়ে হামলায় অভিযুক্ত সেই তৃণমূলই। সেই ঘটনার খবর সংগ্রহে যাওয়া সাংবাদিকদের নিগ্রহ করার অভিযোগও তাদের বিরুদ্ধে।
বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছিলেন, ধর্মঘটে যোগ দেওয়ার মতোই যোগ না-দেওয়ারও অধিকার আছে। ধর্মঘট ‘চাপিয়ে’ দিতে কেউ রাস্তায় নামবে না। কিন্তু বারাসত এবং রাজ্যের আরও কিছু জায়গায় বিক্ষিপ্ত ভাবে বাস্তবে ঘটল তার উল্টো। ধর্মঘটের দিন রাস্তায় বেরোনো বাস থেকে যাত্রীদের জোর করে নামিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠল প্রধান বিরোধী দলের বিরুদ্ধে। প্রতিবাদ করতে গেলে তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগও তাদের বিরুদ্ধে।
নানা প্রান্তে বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনাতেই ফের প্রমাণিত, ধর্মঘটের আগে রাজনৈতিক দলগুলির নেতৃত্ব নানা প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু ধর্মঘটের দিন রাস্তায়, হাটে-বাজারে চলতেই থাকে ‘পেশি শক্তি’র আস্ফালন। যার জেরে আতঙ্কে সরকার তথা প্রশাসনের বিবিধ আশ্বাস সত্ত্বেও ধর্মঘটের দিন ঘর ছেড়ে বেরোতে চান না মানুষ। দিনের শেষে ধর্মঘটকারী এবং ধর্মঘট-বিরোধীদের পরস্পর-বিরোধী দাবি চলতেই থাকে। যেমন চলেছে এ দিনও। মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “পশ্চিমবঙ্গে কোনও বন্ধ হয়নি। সাধারণ মানুষের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এই প্রথম তারা বন্ধ ভাঙলেন!” আর ধর্মঘটকারীদের তরফে সিটুর রাজ্য সভাপতি শ্যামল চক্রবর্তী এ দিন পাল্টা বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ে ভুল আর কেউ বোঝাতে পারেন না! ন’মাস আগের জনসমর্থন সঙ্গে থাকলে মানুষ তাঁদের আহ্বানে সাড়া দিতেন। এ বারের ধর্মঘটের আগে বোঝা গেল, ভয় পেয়েছেন। এখন বোঝা যাচ্ছে, ক্রমশ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন!”
নেতৃত্বের ‘প্রতিশ্রুতি’র বাইরে গিয়ে ঘটনা ঘটানোর ক্ষেত্রে দুই যুযুধান শিবিরই অভিযুক্ত হলেও তা ‘সামাল’ দিতে গিয়ে অবশ্য স্পষ্টতই ফারাক ধরা পড়েছে এ দিন। প্রধান শাসক দলের নেতৃত্ব তাঁদের কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ স্বীকার করেননি, আবার কোথাও ‘সাফাই’ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। পক্ষান্তরে, বিরোধী দলনেতা বলেছেন, তাঁদের দলের বিরুদ্ধে যেখানে অভিযোগ উঠেছে, সেখানে ‘সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক স্তরে’ তাঁরা ব্যবস্থা নেবেন।
এর প্রকৃষ্টতম উদাহরণ হতে পারে যাদবপুর এবং বারাসতের ঘটনা। যাদবপুরের গাঙ্গুলিবাগানে সিপিএমের জোনাল কার্যালয়ে হামলা এবং তার পরে সাংবাদিকদের উপরে আক্রমণের ঘটনা (যেখানে তৃণমূল অভিযুক্ত) প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা এ দিন সাফ বলেছেন, “সাজানো ঘটনা!” মুখ্যমন্ত্রীর ব্যাখ্যা, চার-পাঁচ জন মিলে এমন ঘটনা ‘সাজিয়ে’ নেওয়াই যায়!
আর বারাসতে ধর্মঘটকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে এ দিন আলিমুদ্দিনে বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবু বলেছেন, “খোঁজ নিয়েছি। ধর্মঘটে যোগ না-দেওয়ার অধিকারও আছে। ওখানে জোর করে বাস থেকে নামানোর অভিযোগ আছে। ওঁদের (স্থানীয় নেতাদের) বলেছি, টিভি-তে কী দেখাচ্ছে, দেখুন। ব্যতিক্রম হয়ে থাকলে রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক ভাবে যা করণীয়, করা হবে। যেমন অন্য ঘটনাতেও হয়ে থাকে।”
একই সঙ্গে সূর্যবাবু ফের বলেছেন, “জোর করে কাউকে ধর্মঘট করানো যায় না, এটা আগেও বলেছি। এখনও বলছি।” তবে বিরোধী দলনেতার দাবি, বারাসতে সিপিএমের মিছিল আক্রান্ত হয়েছিল। আহতও হয়েছেন সাত জন।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় দু’দলের নেতৃত্বের মনোভাবে এই পার্থক্যের মতোই দাবি-পাল্টা দাবির লড়াই অব্যাহত থেকেছে আর পাঁচটা ধর্মঘটের মতোই। শিল্পমন্ত্রী তথা তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, “ধর্মঘট মোকাবিলায় মুখ্যমন্ত্রী যে কড়া অবস্থান নিয়েছিলেন, তার ফল মিলেছে। অন্য সরকারি দফতরে যা উপস্থিতি থাকে, এ দিন তার চেয়েও বেশি ছিল!” তাঁর শিল্প দফতরেরই উদাহরণ দিয়েছেন পার্থবাবু।
আবার ধর্মঘটকারী সবক’টি ইউনিয়ন নেতৃত্বকে সঙ্গে নিয়ে সিটুর রাজ্য সভাপতি শ্যামলবাবু বলেছেন, “মহাকরণ কর্মচঞ্চল থাকলে সাংবাদিকদের ছবি তুলতে দিলেন না কেন? তা হলে কি থলে থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়ত?” ধর্মঘট ভাঙতে সরকারের ‘হুঁশিয়ারি’ এবং তার জেরে ‘আতঙ্কে’র পরিবেশই কি তাঁদের ধর্মঘট ‘সফল’ করে দিল? শ্যামলবাবু এবং সিটুর রাজ্য সম্পাদক কালী ঘোষ, দু’জনেই বলেছেন, “এত ভয়ের আবহাওয়া অতীতে দেখিনি ঠিকই। তবে আক্রমণের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য শ্রমিকদের মধ্যে মনোবল তৈরি করতে হয়েছে।” সরকারের শরিক প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যেরও মত, প্রশাসনের ‘হুঁশিয়ারি’র প্রভাবেই অনেক কর্মী কাজে এসেছেন। তবে যাঁরা আসেননি, তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলে ‘ভুল’ হবে।
মহাকরণ-কেন্দ্রিক আলোচনা থেকে বেরোলে বাকি রাজ্যে ধর্মঘটের দিনে ‘বলপ্রয়োগে’র সেই চেনা ছবি। রায়গঞ্জ শহরে তৃণমূল নেতা দিলীপ দাসকে (কংগ্রেসের প্রাক্তন বিধায়ক) ধর্মঘট সমর্থনকারী সিপিএমের নেতা-কর্মীরা রাস্তায় ফেলে মারধর করেন বলে অভিযোগ। দিলীপবাবুর একটি গাড়ি আটকে ধর্মঘট সমর্থকেরা তার চাবি কেড়ে নেন। দিলীপবাবু বলেন, “আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে গাড়িটি ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করলে সিপিএমের লোকেরা আমাকে রাস্তায় ফেলে বেধড়ক পেটায়।”
তৃণমূল সমর্থকেরাও পাল্টা হামলা করে বলে অভিযোগ। জখম হন রায়গঞ্জের হাতিয়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক তথা স্থানীয় সিপিএম নেতা অনিরুদ্ধ সিংহ। তাঁর বক্তব্য, “আমাদের কর্মী-সমর্থকেরা গাড়ির চাবি নিয়েছিলেন ঠিকই। তবে গোলমাল ঠেকাতে আমি ঘটনাস্থলে গেলে দিলীপবাবুর অনুগামী তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরা বাঁশ ও লাঠিসোটা নিয়ে আমাকে বেধড়ক মারধর করে।” দু’জনেই রায়গঞ্জ হাসপাতালে ভর্তি।
আবার মালদহ শহরে প্রাক্তন মন্ত্রী শ্রীকুমার মুখোপাধ্যায়কে নিগ্রহ করার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূল ও কংগ্রেস সমর্থকদের বিরুদ্ধে। শ্রীকুমারবাবু বলেন, “কংগ্রেস ও তৃণমূলের কর্মীরা আমাকে ধাক্কা দেন। পেটে আঘাত করেন। পুলিশ পাঁচ হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকলেও এগিয়ে আসেনি।” অভিযোগ মানেনি কংগ্রেস, তৃণমূল। পুলিশের দাবি, ঘটনাটি তাদের সামনে ঘটেনি। যদিও টিভি চ্যানেলে শ্রীকুমারবাবুর হেনস্থার ছবি ধরা পড়েছে।
ধর্মঘটে দোকান খোলানো নিয়ে সিপিএম-তৃণমূল সংঘর্ষ বাধে পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুরে। দু’পক্ষের জনা তেরো জখম হন। উত্তর ২৪ পরগনার জগদ্দলের গোলঘরে এক সিপিএম নেতা-সহ ৪ জনকে মারধরের অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। আদ্রাতেও তৃণমূলের মিছিল থেকে এক সিপিএম কর্মীর উপরে হামলা করা হয় বলে অভিযোগ। কোনও অভিযোগই মানেনি তৃণমূল। কথা রাখেনি কেউ-ই!
|
সহ-প্রতিবেদন: সঞ্জয় সিংহ, দেবারতি সিংহ চৌধুরী ও জেলা ব্যুরো |