মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য শুনে আর্জি ‘ধর্ষিতা’র
সুবিচার দিতে না পারেন, আমায় হেয় করবেন না
সুবিচার করতে না পারেন, অন্তত লোকসমাজে হেয় করবেন না কাটোয়ায় ট্রেনে ধর্ষণ প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য শুনে এই আর্জিই জানালেন ‘ব্যথিত’ অভিযোগকারিণী।
শুধু ওই মহিলাই নন। মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যে ‘অপমানিত’ বোধ করছে তাঁর গোটা পরিবার। এমনকী রাজনৈতিক দলমত নির্বিশেষে যাঁরা ওই মহিলার পাশে দাঁড়িয়েছেন, সেই গ্রামবাসীরাও ক্ষোভে ফুটছেন।
মঙ্গলবার দুপুরে মহাকরণে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী (পুলিশ তাঁরই দায়িত্বে) বলেন, “শুনেছি, একটি রাজনৈতিক দল এবং তাদের বন্ধুরা ‘ধর্ষণ ধর্ষণ’ বলে চিৎকার করছে। ঘটনাটা সত্যি কি না তা দেখতে হবে।” এই নিয়ে সিপিএম ‘দেউলিয়া রাজনীতি’ করছে দাবি করে তাঁর মন্তব্য, “এই সব ঘটনা যারা সাজাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।”
সোমবার রাতেই মুখ্যমন্ত্রী মন্তব্য করেছিলেন, “সব সিপিএমের চক্রান্ত করে সাজানো।” এ দিন তিনি বলেন, “সে (অভিযোগকারিণী মহিলা) বলেছে, তার স্বামী সিপিএমের স্থানীয় সমর্থক।” যা শুনে মহিলা তো বটেই, স্তম্ভিত গোটা গ্রাম। কেননা একে তো মহিলা বিধবা হয়েছেন ১১ বছর আগে। তার উপর, ওই পরিবারের লোকজন কংগ্রেস ও তৃণমূলের সমর্থক বলেই এলাকায় পরিচিত।
এ দিন মমতার সাংবাদিক বৈঠকের পরেই অবশ্য রেলপুলিশের ডিজি দিলীপ মিত্র বলেন, “ওই মহিলা বিধবা বলেই জানি।” বিধানসভার বিরোধী দলনেতা, সিপিএমের সূর্যকান্ত মিশ্রের প্রতিক্রিয়া, “মুখ্যমন্ত্রী বললেন, সাজানো ঘটনা। তাঁর স্বামী সিপিএম করেন, বলেছেন। মারা যাওয়ার ১১ বছর পরেও সিপিএম করা যায়!”
পরিবার ও গ্রাম সূত্রে জানা যায়, ২০০০ সালের ১ সেপ্টেম্বর পেয়ারা পাড়তে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মাত্র ২৭ বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন মহিলার স্বামী। তাঁর ছোট মেয়ে, গত শনিবার রাতে যার সামনে মহিলাকে ট্রেন থেকে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ, সে তখন মোটে ২৩ দিনের শিশু। এ দিন বিকেলে নিজের বাড়িতে বসে স্বামীর ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ বাড়িয়ে ধরে মহিলা বলেন, “সুবিচারের ব্যবস্থা করতে না পারুন, অন্তত আমার দুই মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে লোকসমাজে আমাকে আর হেয় করবেন না।”
সিপিএমের প্রসঙ্গ কোথা থেকে আসছে, বস্তুত সেটাও বুঝতে পারছেন না পরিবার তথা এলাকার মানুষ। বিকেলে কেতুগ্রামে নবগ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় মহিলার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, কংগ্রেস এবং তৃণমূল দুই দলেরই পতাকা রয়েছে। পরিবার ও গ্রাম সূত্রে জানা যায়, মহিলার স্বামী কংগ্রেস সমর্থক হলেও সক্রিয় রাজনীতি করতেন না। আটের দশকে পঞ্চায়েত নির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থী হয়েছিলেন তাঁর মেজো ভাসুর, যদিও হেরে যান। ১৯৮৯ থেকে ’৯৯ পর্যন্ত চারটি লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ‘পোলিং এজেন্ট’ও ছিলেন তিনি। গত বিধানসভা নির্বাচনে কেতুগ্রাম কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থীর হয়ে মিটিং-মিছিল করেন মহিলার দেওর-সহ পরিবারের কয়েক জন।
ঘটনার পর থেকেই যিনি সারা ক্ষণ মহিলা ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে ছিলেন, সেই কেতুগ্রাম ২ ব্লক তৃণমূল সভাপতি বিকাশ মজুমদারও স্বীকার করেন, “ওই পরিবারটি বরাবর সিপিএম বিরোধী হিসেবেই পরিচিত। এখন ওঁরা আমাদের সমর্থক।” ব্লক কংগ্রেস সভাপতি অরবিন্দ সেনের বিস্ময়, “দীর্ঘদিন ধরেই ওঁরা আমাদের সমর্থক। মুখ্যমন্ত্রী কী করে সিপিএমের চক্রান্ত বললেন, কে জানে!” গ্রামেরই বাসিন্দা, সিপিএমের পঞ্চায়েত প্রধান রিনা ঘোষ বলেন, “ওঁরা কোনও দিনই আমাদের সমর্থক ছিলেন না, এখনও নয়। ভুলভাল কথা বলা মুখ্যমন্ত্রীর যেন স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
বর্ধমানের কেতুগ্রামে পাচুন্দি ও অম্বল গ্রামের মাঝে কাটোয়া-আমোদপুর ন্যারোগেজ লাইনে ট্রেন থেকে নামিয়ে মহিলাকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পরে রাতেই তাঁর বাড়িতে গিয়েছিল রেলপুলিশ। পরিবার সূত্রের খবর, প্রথমে বাড়িতে আসা রেলপুলিশের দুই কর্মীর কাছে তিনি মুখ খোলেননি। পরে বিকাশবাবু বাড়িতে এসে পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দেওয়ায় তিনি কাটোয়া জিআরপি থানায় অভিযোগ জানান। সেই রাতেই রেলপুলিশ তাঁর ডাক্তারি পরীক্ষা করায়।
ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণের ‘প্রমাণ’ মেলেনি বলে মুখ্যমন্ত্রী সোমবারই মন্তব্য করেছিলেন। এ দিন তিনি ফের বলেন, “ডাক্তারি প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এই তো ডিজি আছেন, ডিজি-কে জিজ্ঞাসা করুন। কিছু পাওয়া গিয়েছে?” পাশে দাঁড়িয়ে রাজ্য পুলিশের ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায় বলেন, “পাওয়া যায়নি।” এর পরেই মমতার মন্তব্য, “সত্যি কথা বললে পুলিশ নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু মিথ্যা অভিযোগ সাজানো খুনের মতোই ফৌজদারি অপরাধ, মনে রাখবেন।”
যদিও পুলিশ ‘সরকারি ভাবে’ ডাক্তারি রিপোর্ট জেনেছে কি না, তা পরিষ্কার নয়। কেননা এ দিনই রাজ্য পুলিশের হাতে তদন্তভার দেওয়ার জন্য রেলপুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে কাটোয়া আদালত। বর্ধমানের পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা বলেন, “এখনও পর্যন্ত তদন্ত সংক্রান্ত কোনও কাগজপত্র বা রিপোর্ট আমরা হাতে পাইনি।”
হেয় করবেন না। মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যের পরে করজোড়ে আর্জি কেতুগ্রামের
‘ধর্ষিতা’ ও তাঁর শাশুড়ির। মঙ্গলবার অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।
ইতিমধ্যে রেলপুলিশের ডিজি দিলীপবাবু দাবি করেন, “ঘটনার রাতেই মহিলার ডাক্তারি পরীক্ষার রিপোর্ট পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। তবে তাতে কী আছে তা আমার জানা নেই।” ধর্ষণের কোনও প্রমাণ মিলেছে? সরাসরি উত্তর এড়িয়ে তাঁর জবাব, “সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, কোনও মহিলা পুলিশে ধর্ষণের অভিযোগ করলেই তার গুরুত্ব অনেক।”
পুলিশ সূত্রের দাবি, ডাক্তারি পরীক্ষায় মহিলার যৌনাঙ্গে আঘাতের চিহ্ন মেলেনি। তবে মহিলা প্রথম দিনেই জানিয়েছিলেন, দুষ্কৃতীরা রিভলভার ও ভোজালি উঁচিয়ে তাঁকে ও তাঁর মেয়েকে খুনের হুমকি দিতে থাকায় তিনি ‘আত্মসমর্পণ’ করতে বাধ্য হন। চিকিৎসকদের একাংশের মতে, ভয়ে কেউ ‘আত্মসমর্পণ’ করলে ধর্ষণ সত্ত্বেও তাঁর যৌনাঙ্গে আঘাতের চিহ্ন না-ও থাকতে পারে।
প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী, চিকিৎসক সূর্যকান্ত মিশ্রের দাবি, “ফরেন্সিক সায়েন্স না-বুঝেই মুখ্যমন্ত্রী বলে দিচ্ছেন মেডিক্যাল রিপোর্ট ‘নেগেটিভ’। অথচ সম্পূর্ণ ফরেন্সিক রিপোর্ট আসার আগে এই ভাবে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায় না।” তাঁর কটাক্ষ, “মেডিক্যাল রিপোর্টও মুখ্যমন্ত্রী বুঝতে শুরু করেছেন এখন! আজকাল আবার ডিজি-কে পাশে দাঁড় করিয়ে রাখেন। নতুন সংস্কৃতি শুরু হয়েছে!” এর পরেই তাঁর সংযোজন, “মুখ্যমন্ত্রীই অফিসার, তিনিই আদালত, তিনিই ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ, তিনিই অন্য সব মন্ত্রী! সত্যিই ঐতিহাসিক কর্মসংস্কৃতি হয়েছে।”
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের আশঙ্কা, “তদন্ত শেষের আগেই মুখ্যমন্ত্রী ‘সাজানো ঘটনা’ বললে কোনও মহিলা আর এ ধরনের অভিযোগ করার ভরসাই পাবেন না!” কাটোয়ার বিধায়ক তথা প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, “মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ভুল তথ্য যাচ্ছে। এক জন মহিলা কেন অকারণে মিথ্যা বলবেন?” সিপিএমের বর্ধমান জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, কাটোয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত অচিন্ত্য মল্লিকের মতে, “মেডিক্যাল রিপোর্ট আসেনি, রাজ্য পুলিশ কার্যত তদন্তেই নামেনি, এর মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর এই ধরনের মন্তব্য তদন্তকে প্রভাবিত করবে।”
এ দিন বিকেলে মহিলার গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে অধিকাংশ গ্রামবাসী ক্ষোভে ফুটছেন। নিজেদের তৃণমূল সমর্থক বলে দাবি করে গ্রামের গৌতম দাস, রবীন্দ্রনাথ দাসেরা বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী ঠিক বলছেন না। এর মধ্যে কোথাও রাজনীতি নেই। এক মহিলার লড়াইকে উনি ছোট করে দিচ্ছেন।” দলের সমর্থক হওয়াতেই বিকাশবাবু এত তৎপরতা দেখিয়েছেন বলেও গ্রামবাসীর একাংশের দাবি।
এক মুখ দুই কথা

কেতুগ্রাম ২ ব্লক তৃণমূল সভাপতি
ঘটনার রাতে
ভয়ঙ্কর ঘটনা। পুলিশ ও রেল পুলিশ কর্তৃপক্ষকে যত
দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছি।
মুখ্যমন্ত্রী ‘চক্রান্ত’ বলার পরে
চক্রান্ত সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী যা বলছেন, ঠিকই বলছেন বলে
এখন আমার মনে হচ্ছে। কিন্তু গ্রামের মানুষ হিসেবে, আমাদের
দলের সমর্থক হিসেবে ওঁদের পাশে ছিলাম, এখনও আছি।
তবে বিকাশবাবুর বয়ান এ দিন কিছুটা বদলে গিয়েছে। শনিবার রাতে তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল, “ভয়ঙ্কর ঘটনা। পুলিশ ও রেলপুলিশ কর্তৃপক্ষকে যত দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছি।” টানা থানা-পুলিশ-হাসপাতাল সামলানো তো বটেই, এ দিন দুপুর পর্যন্ত তিনি একাধিক বার ফোন করে তাঁদের ভালমন্দের খবর নেন বলে পরিবার সূত্রের খবর। অথচ মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যের পরে বিকেলে তিনি বলেন, “চক্রান্ত সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী যা বলছেন, ঠিকই বলছেন বলে এখন আমার মনে হচ্ছে। কিন্তু গ্রামের মানুষ হিসেবে, আমাদের দলের সমর্থক হিসেবে আমি ওঁদের পাশে ছিলাম, এখনও আছি।” বর্ধমান জেলা তৃণমূল সভাপতি (গ্রামীণ) স্বপন দেবনাথের বক্তব্য, “গ্রামের লোক হিসেবে বিকাশ ওঁদের সাহায্য করতে যেতেই পারে। এ ছাড়া যা বলার মুখ্যমন্ত্রীই বলে দিয়েছেন। আমার কিছু বলার নেই।”
প্রথম রাত থেকেই পরিবারের সবাইকে জড়ো করে বৌমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন মহিলার শাশুড়ি। এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর
মন্তব্য শুনে তিনি কার্যত রুখে ওঠেন, “এত বড় মিথ্যা মমতা কী করে বলছেন সেটাই ভাবতে পারছি না। ভগবান ওঁকে পাপ দেবেন।” বড় ঘোমটায় মুখ ঢেকে তখন পাশে বসে তাঁর বৌমা। ক্লান্ত গলায় তিনি বলেন, “ভেবেছিলাম, মুখ্যমন্ত্রী আমার দুঃখের সাথী হবেন। তার বদলে উনি আমাকেই দোষী সাব্যস্ত করতে চাইছেন!”
এর পরেই হাতজোড় করে তাঁর অনুরোধ, “আমায় আর হেয় করবেন না। এখনও আমার অনেক লড়াই বাকি।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.