পুরুলিয়ার তৃণমূল জেলা সভাপতির পদ থেকে রাজ্যের স্বনির্ভর ও স্বনিযুক্তি মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতোকে সরানোর দাবি ফের তুললেন তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশ। সম্প্রতি দলের জেলা নেতৃত্বের একাংশ বৈঠক করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শান্তিরামবাবুর পরিবর্তে তাঁরা ‘সর্বক্ষণের জেলা সভাপতি’ নির্বাচনের জন্য দাবি তুলে প্রাথমিক ভাবে দলের রাজ্য নেতৃত্বকে জানিয়েছেন। তৃণমূল সূত্রের খবর, মার্চ মাসের গোড়ায় দলের এই ‘বিক্ষুদ্ধ নেতৃত্ব’ তৃণমূল নেত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে পুরুলিয়ার সভাপতি পরিবর্তনের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে চাইছেন। শান্তিরামবাবু অবশ্য বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে চাইছেন না।
২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের পরে পুরুলিয়ায় দলের জেলা সভাপতি পরিবর্তন করেছিলেন দলনেত্রী। বর্ষিয়ান তৃণমূল নেতা কে পি সিংহদেও-কে সরিয়ে জেলা সভাপতি করা হয় কংগ্রেস ছেড়ে সদ্য তৃণমূলে আসা শান্তিরাম মাহাতোকে। তা নিয়ে দলের পুরনো নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিস্তর ক্ষোভ দেখা দেয়। কিন্তু প্রকাশ্যে দলনেত্রীর বিরুদ্ধাচারণ করার সাহস দেখাননি কেউ। কিন্তু পরে কয়েকটি ব্লকের সভাপতি পাল্টানোর ঘটনাকে ঘিরে দলের অর্ন্তদ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। শান্তিরামবাবুর নেতৃত্বকে কার্যত ‘চ্যালেঞ্জ’ জানিয়েছিলেন কিছু ব্লক ও জেলা কমিটির প্রথম সারির নেতা। শেষ পর্যন্ত দলের শীর্ষ নেতৃত্বের হস্তক্ষেপে বিরোধ প্রশমিত হয়। পরে বিধানসভা নির্বাচনে ভাল ফল হওয়ায় দলে শান্তিরামবাবুর নেতৃত্ব আরও সুদৃঢ় হয়।
কিন্তু এ বার পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রস্তুতিকে সামনে রেখে জেলা সভাপতি পরিবর্তনের দাবি ওঠায় ফের শান্তিরামবাবুর নেতৃত্ব নিয়ে দলীয় দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিচ্ছে। তৃণমূল সূত্রের খবর, সম্প্রতি পুরুলিয়া শহরের একটি লজে এ ব্যাপারে বৈঠক করেছেন দলের জেলা নেতাদের একাংশ। উপস্থিত ছিলেন জেলার কার্যকরী সভাপতি সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায়, দুই সাধারণ সম্পাদক বিষ্ণুচরণ মেহেতা, সলিল নন্দী, ৯ জন সম্পাদক, ২৩ জন জেলা কমিটির সদস্য এবং কিছু প্রাক্তন ব্লক সভাপতি-সহ ব্লকের নেতৃত্ব। এ ছাড়াও ছিলেন কয়েকটি শাখা সংগঠনের নেতারা। তাঁদের মতে, শান্তিরামবাবু মন্ত্রী হওয়ার পরে সরকারি কাজকর্মে জড়িয়ে পড়েছেন। দলের কাজে আগের মতো তিনি আর সময় দিতে পারছেন না। সম্প্রতি একই যুক্তিতে রাজ্যের অন্যতম মন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাসকে নদিয়ার জেলা সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই কারণে জেলায় সর্বক্ষণের জন্য নতুন সভাপতি নির্বাচন করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
তবে ওই বৈঠককে জেলা সভাপতির বিরুদ্ধে জেহাদ বা অন্তর্দ্বন্দ্ব বলতে নারাজ জেলা কার্যকরী সভাপতি সুজয়বাবু বন্দ্যোপাধ্যায় ও সাধারণ সম্পাদক বিষ্ণুচরণ মেহেতা। সুজয়বাবুর দাবি, ‘সার্কুলার’ দিয়ে ওই বৈঠক ডাকা হয়নি। জেলায় দলের বর্তমান সাংগঠনিক অবস্থা বিশ্লেষণ করার জন্য তাঁরা নিজেদের মধ্যে বৈঠক করেছেন। তিনি বলেন “আলোচনায় উঠে এসেছে শান্তিরামবাবু মন্ত্রী হওয়ার পরে দলের সংগঠনের কাজে সময় দিতে পারছেন না। সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচন। এই সময়ে সাংগঠনিক কাজকর্মে ঘাটতি থাকলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ওই নির্বাচনে। সেই প্রেক্ষিতেই দলে সর্বক্ষণের জেলা সভাপতি দরকার।”
বিষ্ণুবাবু বলেন, “রাজ্যে উন্নয়নের কাজে গতি আনতে বিভিন্ন দফতরগুলিকে আরও বেশি সক্রিয় করার নির্দেশ দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। এই অবস্থায় শান্তিরামবাবুর পক্ষে দলের কাজ দেখা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ দল ও সরকারের মধ্যে সমন্বয়েরও প্রয়োজন। ফলে সর্বক্ষণের জেলা সভাপতি দরকার।” জেলার অন্যতম সম্পাদক তথা দলের সরকারি কর্মী সংগঠনের নেতা অমর মাহাতো বলেন, “পঞ্চায়েত নির্বাচন আসন্ন। তাই দলের সংগঠনকে চাঙ্গা করার উপর গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। কারণ জেলা সভাপতি তথা রাজ্যের মন্ত্রী নিজের দফতরের দায়িত্ব ও সরকারি কাজে জড়িয়ে পড়ায় সাংগঠনিক ক্ষতি হচ্ছে। তাই বৈঠকে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, দলে সর্বক্ষণের জেলা সভাপতি দরকার।” তাঁদের দাবি, তৃণমূলের জন্ম লগ্ন থেকে যাঁরা দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের মধ্যে থেকেই নতুন সভাপতি নির্বাচন করা হোক। ঘটনা হল, এই বৈঠক থেকে রাজ্য নেতৃত্বকে সভাপতি বদলের দাবি জানানো-- সবটাই হয়েছে শান্তিরামবাবুর অজান্তে।
কিন্তু ওই বৈঠককে আদৌ গুরুত্ব দিচ্ছেন না শান্তিরামবাবূ। তিনি বলেন, “নিজেদের মধ্যে কেউ আলাপ আলোচনা করতেই পারেন। ব্যাপারটি উপদলীয় কাজ বলেও মনে করছিনা।” তাঁর দাবি, “মন্ত্রকের দায়িত্ব সামলেও দলের কাজে আরও বেশি সময় দিতে আমার সমস্যা নেই। তবে যাঁরা সভাপতি বদলের দাবি করছেন, তাদের মনে রাখা দরকার আমাদের দলে সাংগঠনিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন দলনেত্রী।” তাঁর শিবিরের বক্তব্য, তাঁকে জেলা সভাপতির পদে বসিয়েছেন স্বয়ং দলনেত্রী। তাঁকে দায়িত্ব দেওয়ার পরে জেলায় তৃণমূলের বিস্তার যে বেড়েছে, তার প্রমান বিধানভা নির্বাচনের সাফল্য। ফলে দলের একাংশের তোলা ‘অযৌক্তিক’ দাবি কোনওভাবেই রাজ্য নেতৃত্বর কাছে প্রতিষ্ঠা পাবে না। শনিবার শান্তিরামবাবু পুরুলিয়ায় জেলা কমিটির বৈঠক ডাকলেও লক্ষণীয় ভাবে তাঁর বিক্ষুদ্ধ জেলা নেতারা অনেকেই গরহাজির ছিলেন। দলের মধ্যে ফের পুরনো ফাটল দেখা দিয়েছে, এই ঘটনায় তা আরও স্পষ্ট হল। |