|
|
|
|
ঘটনার তদন্তে এগরায় ডিআইজি |
গণধর্ষণের অভিযোগে দু’জনকে পিটিয়ে খুন |
অমিত কর মহাপাত্র • এগরা |
কেতুগ্রামের রেশ কাটতে না কাটতেই এক বধূকে গণধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগ উঠল এগরায়। অভিযুক্ত দুই যুবককে পিটিয়ে মারা হল। নিহত এক জনের পরিবার খুনের অভিযোগ দায়ের করেছে ওই বধূর বাড়ির লোক-সহ কিছু গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে। এই ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। পুলিশ ও গ্রামবাসীর ‘পরস্পরবিরোধী’ বক্তব্যকে ঘিরে তৈরি হয়েছে সংশয়।
শনিবার গভীর রাতে এগরা থানার দুবদা গ্রামের ওই ঘটনাকে ঘিরে দিনভর উত্তেজনা ছিল রবিবারও। ঘটনার গুরুত্ব বুঝে এ দিন ঘটনাস্থলে যান ডিআইজি (মেদিনীপুর রেঞ্জ) বিনীত গোয়েল, পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার অশোক প্রসাদ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গ্রামীণ) উজ্জ্বল ভৌমিক। গ্রামে পুলিশ, কমব্যাট ফোর্স মোতায়েন হয়েছে। বছর পঁয়ত্রিশের জখম ওই বধূ এখন এগরা মহকুমা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁর মুখে ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গভীর ক্ষত রয়েছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে, ওই বধূ ‘গণধর্ষণের শিকার’ রটে যাওয়ার পরে তাঁর পরিজন-পড়শিরা স্নেহময় বর (৩৫) ও শিবু জানাকে (২০) বেধড়ক মারধর করেন। এ দিন সকাল ৫টা নাগাদ দুবদা পঞ্চায়েত অফিসের পাশের মাঠে পড়ে থাকতে দেখা যায় ওই দু’জনকে। শিবুর দেহে তখনও প্রাণ ছিল। পঞ্চায়েতের উপপ্রধান খগেন্দ্রনাথ দুয়ারির অভিযোগ, “শনিবার রাত দু’টো নাগাদ পুলিশ ওই দু’জনকে নিয়ে যায় চিকিৎসার জন্য। কিন্তু রবিবার সকালে ওদের মাঠ পড়ে থাকতে দেখে আমরা অবাক হই। খবর পেয়ে ফের আসে পুলিশ। কিন্তু ছ’টার কিছু পরেই শিবুও মারা যায়। গণরোষে ওই দু’জন মার খেলেও মৃত্যুর জন্য দায়ী পুলিশই!” |
 |
গণপিটুনিতে নিহত দুই সন্দেহভাজন। ছবি: কৌশিক মিশ্র |
যদিও পুলিশ সুপারের দাবি, “রাতে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলেও প্রহৃতদের খুঁজে পায়নি। শুধু ওই মহিলাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। এ দিন গ্রামে গিয়ে দু’টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।” স্থানীয় সূত্রে অবশ্য জানা যাচ্ছে, প্রহৃত দু’জনকে কিছু গ্রামবাসীই গাড়ি করে এগরা হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলেন। সামনে ছিল পুলিশের জিপ। মাঝপথে স্নেহময়ের মৃত্যু হওয়ায় ‘ঝামেলা এড়াতে’ গাড়ি থেকে পঞ্চায়েত অফিসের সামনে দু’জনকে ফেলে পুলিশকর্মী ও গ্রামবাসীরা ফিরে যান বলে অভিযোগ।
আবার হাসপাতাল সূত্রের খবর, জখম ওই বধূকে শনিবার রাত ১১টা নাগাদ পুলিশ নয়, ভর্তি করান তাঁর পরিজনেরাই। এ দিন বিকেলে হাসপাতালে তাঁর সঙ্গে কথা বলেন পুলিশকর্তারা। তার পরেই শিবু ও স্নেহময়ের বিরুদ্ধে ধর্ষণের চেষ্টা, শ্লীলতাহানি, মারধর, খুনের চেষ্টার অভিযোগ দায়ের করেন বধূ। আজ, সোমবার ওই বধূর ডাক্তারি পরীক্ষা হবে। অন্য দিকে, এ দিন সকালে নিহত স্নেহময়ের দাদা মৃত্যুঞ্জয় বর ওই বধূর স্বামী, দেওর-সহ এলাকার ন’জনের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ দায়ের করেন। কেউই অবশ্য ধরা পড়েনি। অভিযুক্তেরা পলাতক বলে পুলিশের দাবি।
মধ্য দুবদার বাসিন্দা ওই বধূ স্বামীর সঙ্গে তাজপুর-পানিপারুল রাস্তার সন্ধ্যা মোড়ে মুদির দোকান চালান। শনিবার রাত ৯টা নাগাদ স্থানীয় এক ব্যক্তির সঙ্গে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। মাঝপথে মাঠের আল দিয়ে আলাদা পথ ধরেন। ওই বধূর অভিযোগ, সেই সময় তিনি মোবাইলে তাঁর দেওরের বন্ধু মানিকরতন দাসের সঙ্গে কথা বলছিলেন। হঠাৎ পিছন থেকে তাঁর মুখ চেপে ধরে তিন জন। ফোনটা কেটে যায়। এ দিন হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে ওই বধূ দাবি করেন, “ধস্তাধস্তির সময় শিবু আর স্নেহময়কে চিনতে পারি। সেই সময়ই মানিক আবার ফোন করে। ফোনটা ধরি।
কিন্তু ওরা মোবাইল কেড়ে নিয়ে বন্ধ করে দেয়। তার পর জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে আমার গয়না-কাপড়-চোপড় খুলে ফেলে অত্যাচার চালায়। ওরা আমার গলা টিপে ধরে। পেটে লাথিও মারে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান হারাই। আর কিছু মনে নেই।” মানিকেরও দাবি, “বৌদির সঙ্গে কথা বলার সময় আচমকাই ফোন কেটে যায়। আবার ফোন করতেই গোঙানির আওয়াজ শুনি। বৌদির মোবাইলও বন্ধ হয়ে যায়। বিপদ বুঝে ওঁর দেওরকে ফোন করি।” খবর পেয়ে এলাকা ঘিরে ফেলেন গ্রামের লোকজন। সংজ্ঞাহীন অবস্থায় বধূর দেহ উদ্ধার হয়। গ্রামবাসীদের একাংশের দাবি, জঙ্গলে শিবুর দেখা মেলে। তিনি জেরায় স্নেহময়ের নাম জানান। এর পরে উত্তেজিত জনতা স্নেহময়কে বাড়ি থেকে টেনে নিয়ে আসে। দু’জনকে বেধড়ক মারধর করা হয়। অভিযুক্ত তৃতীয় ব্যক্তির নাম-পরিচয় জানার চেষ্টা করছে পুলিশ।
পুলিশের কাছে ওই বধূ জানিয়েছেন, ধস্তাধস্তির সময় তিনি এক জনের হাতে জোরে কামড় দিয়েছিলেন। পুলিশ জানিয়েছে, নিহত শিবুর হাতে কামড়ের দাগ মিলেছে। পাশাপাশি শিবুর মোটরবাইকও পাওয়া গিয়েছে ওই জঙ্গল লাগোয়া পিচরাস্তার ধারে। শিবু কয়েক মাস আগেই ওই মোটরবাইক কিনেছিল। আবার স্নেহময়ের বাড়ি থেকে একটি রক্তমাখা গামছা উদ্ধার হয়েছে বলেও পুলিশের দাবি। পেশায় চাষি স্নেহময়ের বাড়ি দুবদা গ্রামরাজে। শিবুর বাড়ি স্থানীয় পানিপারুল গ্রামে হলেও কাঠকলে কাজ করার সুবাদে দুবদাতেই তিনি থাকতেন। দু’জনের আচার-আচরণ নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভ আগে থেকেই ছিল। যদিও নিহতদের পরিবারের লোকজন ধর্ষণের অভিযোগ মানতে নারাজ। শিবুর বাবা হিমাংশু জানার দাবি, “আমার ছেলে এই কাজ করতে পারে না।”
নিহত স্নেহময়ের ছেলে সুজন ও মেয়ে সৌমিতা বলে, “শনিবার সন্ধ্যায় পড়তে গিয়েছিলাম। ৯টা নাগাদ বাবা সেখান থেকে আমাদের নিয়ে আসে। তার পর খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়ে।” তাদের মা মিঠুরানি বর এ দিন বলেন, “আমি আর শাশুড়ি ছুটে গিয়ে গ্রামবাসীদের কতবার বলি, ওদের দু’জনকে ছেড়ে দিতে। কেউ কোনও কথা শোনেনি। চোখের সামনে দেখলাম দু’জনে নেতিয়ে পড়ল। পরে পুলিশ এসে ওদের নিয়ে যায়।” তাঁরও দাবি, পুলিশ সময়মতো হাসপাতালে নিয়ে গেলে অন্তত এক জনের প্রাণ হয়তো বাঁচানো যেত। |
|
|
 |
|
|