এক দিকে হতাশা। অন্য দিকে উল্লাস, এমনকী মিষ্টি বিতরণও। কিছু মহলে শুরু হয়ে গিয়েছে পরস্পরের পিঠ চাপড়ানিও। অবৈধ করাতকল বিরোধী অভিযানের নেতা, রাজ্যের প্রধান মুখ্য বনপাল (পিসিসিএফ) মির্জা আসগর সুলতানের ক্ষমতা খর্ব হওয়ার পরে রবিবার এটাই ছিল প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া।
শনিবার মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘরে বৈঠক শেষে সুলতানের ক্ষমতা ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরে রবিবার থেকেই লাইসেন্সহীন করাতকলের বিরুদ্ধে অভিযানে কার্যত দাঁড়ি পড়ে গিয়েছে। বিভিন্ন কলের মালিক-কর্মীদের একাংশ মিষ্টিও বিলি করেছেন। বাম আমলের দুই প্রাক্তন বনমন্ত্রী (উত্তরবঙ্গের বাসিন্দা) বর্তমান বনমন্ত্রীর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। অন্য দিকে, রাতারাতি অভিযান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বন দফতরের অফিসার-কর্মীদের একাংশের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে হতাশা ও উদ্বেগ। যদিও পরিবেশপ্রেমীরা এত সহজে হাল ছাড়তে নারাজ। বনমন্ত্রী-বনকর্তার এই ‘দ্বন্দ্বে’ রাজ্যের বিভিন্ন পরিবেশপ্রেমী সংগঠন সুলতানের পাশে দাঁড়িয়েছে। অভিযান অব্যাহত রাখতে পরিবেশপ্রেমীদের অনেকে উচ্চ আদালতে জনস্বার্থ-মামলা করার কথা ভাবছেন। আন্দোলনে নামার হুমকিও দিয়েছেন কেউ কেউ। |
বনমন্ত্রী হিতেন বর্মন অবশ্য উদ্বেগের কোনও কারণ দেখছেন না। এ দিন তিনি বলেন, “জনপ্রতিনিধিদের সব কিছু মাথায় রাখতে হয়। এক দিকে আইন মেনে চলতে হয়। আবার গরিব মানুষ যাতে রাতারাতি কর্মহীন হয়ে না-পড়েন, সে খেয়ালও রাখতে হয়। যত দ্রুত সম্ভব করাতকলের লাইসেন্সের আবেদন খতিয়ে দেখে পদক্ষেপ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।” বন দফতর সূত্রের খবর: মন্ত্রীর নির্দেশ পেয়ে এ দিনই অরণ্য ভবনে লাইসেন্স সংক্রান্ত নথিপত্র নিয়ে বৈঠক করেছেন সদ্য নিযুক্ত পিসিসিএফ (জেনারেল) অতনু রাহা। আজ, সোমবারের মধ্যে লাইসেন্স সংক্রান্ত জটিলতার নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার চেষ্টা হবে।
এ দিকে ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রাক্তন সাংসদ হিতেনবাবু তৃণমূলে গিয়ে মন্ত্রী হলেও তাঁর পিছনে দাঁড়িয়েছেন বাম জমানার দুই প্রাক্তন বনমন্ত্রী সিপিএমের যোগেশ বর্মন ও অনন্ত রায়। যোগেশবাবুর মন্তব্য, “দুম করে করাতকল বন্ধ করা ঠিক নয়। এতে অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়বেন। আমরা তা করিনি।” আর অনন্তবাবুর দাবি, “আমরা তো লাইসেন্সের জন্য আবেদনকারী করাতকলের তালিকা তৈরি করেছিলাম। তা খতিয়ে দেখে কাজ করা উচিত। বর্তমান রাজ্য সরকার বুঝতে পেরেছে যে, আমাদের পথেই হাঁটা দরকার।” উত্তরবঙ্গের একাধিক সিপিএম নেতা জানিয়েছেন, ‘প্রাক্তন কমরেড’ হিতেনবাবুর উপরে এখনও তাঁদের ‘আস্থা’ রয়েছে।
বন দফতর-সূত্রের খবর: মির্জা আসগর সুলতান আসলে ‘মৌচাকে’ ঢিল মেরেছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে প্রধান মুখ্য বনপালের দায়িত্ব নিয়েই জঙ্গল বাঁচাতে কঠোর মনোভাব দেখানোর পাশাপাশি দীর্ঘ দিন একই জায়গায় থাকা ‘প্রভাবশালী’ বন-অফিসারদের বদলির প্রক্রিয়াও শুরু করেন তিনি। রাজ্যের সমস্ত অবৈধ করাতকল বন্ধের নির্দেশও দেন। এবং তা ঘিরেই বনমন্ত্রীর সঙ্গে সংঘাতের সূত্রপাত, যাতে হস্তক্ষেপ করতে হয় খোদ মুখ্যমন্ত্রীকে। বিতর্কের জেরে শনিবার সুলতানকে মূলত পিসিপিএফদের মধ্যে সমন্বয়ের দায়িত্ব দিয়ে অতনুবাবুর হাতে ছাড়া হয় প্রশাসন, বাজেট, করাতকল সংক্রান্ত নানা বিষয়ের ভার।
আর সুলতান এ ভাবে ‘কোণঠাসা’ হওয়ায় করাতকল মালিকদের অধিকাংশই খুশি। যেমন, কোচবিহার জেলার ‘ভিনিয়ার অ্যান্ড প্লাইউড মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক প্রদীপ দে বলেন, “তাড়াহুড়ো করে মিল বন্ধ হলে শ্রমিকদেরও সমস্যা হতো। এখন আশার
আলো দেখছি। মুখ্যমন্ত্রী, বনমন্ত্রীকে ধন্যবাদ।”
অন্য দিকে বন দফতরের যে সব অফিসার-কর্মী আইন মেনে জঙ্গল বাঁচাতে কড়া হাতে উদ্যোগী হয়েছিলেন, তাঁরা হতাশ। ওঁদের আশঙ্কা, নতুন সিদ্ধান্তে আবার অবৈধ করাতকলের রমরমা বাড়বে, বিপন্ন হবে সবুজ। পাশাপাশি ফের অতনুবাবুকে বাড়তি দায়িত্ব দেওয়ায় বন দফতরে ‘নিয়ম বহির্ভূত’ খরচের বিষয়টা ধামাচাপা পড়ে যেতে পারে বলে ওঁদের অনেকে মনে করছেন। এঁদের দাবি: সম্প্রতি বিশেষ অডিটে ধরা পড়েছে, বাম জমানায় দফতরে তিন বছরে (২০০৭-২০০৮ থেকে ২০১০-২০১১) নিয়ম ভেঙে ১২১ কোটি টাকা খরচ হয়েছে, যে সময়কালের সিংহভাগ প্রধান মুখ্য বনপালের দায়িত্বে ছিলেন অতনুবাবু। তিনি এ বার দায়িত্ব ফিরে পাওয়ায় বাম আমলের দুই বনমন্ত্রীও কিছুটা নিশ্চিন্ত বলে বনকর্মী ও অফিসারদের একাংশের ধারণা। বর্তমান মন্ত্রীর কী বক্তব্য?
বনমন্ত্রী হিতেনবাবু বলেন, “একশো কোটির বেশি নিয়ম বহির্ভূত ভাবে খরচ হয়েছে বলে স্পেশ্যাল অডিটের রিপোর্ট পেয়েছি। অর্থ দফতরের অনুমোদন ছাড়া বিভিন্ন খাতে ওই খরচ করা হয়। পরে রাজ্য সরকার তা অনুমোদন করেছিল। নিয়ম অনুযায়ী, ওই সব খরচের আগে অর্থ দফতরের অনুমোদন নেওয়া দরকার ছিল।” কিন্তু ওই অনিয়মের জন্য দায়ীদের চিহ্নিত হবে না?
বনমন্ত্রী বলেন, “আমরা স্বচ্ছতা আনতে বদ্ধপরিকর। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, দফতরের নির্মাণ বা উন্নয়নের কাজ ট্রেজারির অনুমোদন ছাড়া করা যাবে না। আগে এটা ডিএফও-রা সরাসরি করতে পারতেন। ১ এপ্রিল নতুন ব্যবস্থা চালু হচ্ছে।” তবে জরুরি খাতে খরচের জন্য নির্দিষ্ট বরাদ্দ আগাম মঞ্জুর করা থাকবে বলে বনমন্ত্রী জানান। অতনুবাবুকে ফের বাজেট সংক্রান্ত যাবতীয় দায়িত্ব দেওয়া ঠিক হল কি না জানতে চাইলে মন্ত্রীর জবাব, “উনি (অতনুবাবু) তো আর খরচ করেননি! আইন আইনের পথে চলবে।”
এ দিন অতনুবাবুর সঙ্গে বহু বার যোগাযোগ করার চেষ্টা হলেও তাঁর মোবাইল বেজে গিয়েছে। এসএমএসেরও জবাব মেলেনি। সুলতানও এ দিন কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তাঁর এক আত্মীয় বলেন, “উনি কোনও কথা বলবেন না।”
তবে পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত, ন্যাফের অনিমেষ বসু কিংবা আলিপুরদুয়ার নেচার ক্লাবের অমল দত্তেরা অবৈধ করাতকল বিরোধী অভিযান বন্ধের সমালোচনা করেছেন। সুভাষবাবু বলেন, “যা পরিস্থিতি, তাতে জনস্বার্থ-মামলা করা ছাড়া উপায় নেই।” অনিমেষবাবুর অভিযোগ, “এমন চললে তার প্রভাব পড়বে বন্যপ্রাণী ও বন সংরক্ষণে।” আলিপুরদুয়ার অভিভাবক মঞ্চের সম্পাদক ল্যারি বসুর আক্ষেপ, “যা হল, তাতে জঙ্গলরক্ষা মুশকিল হবে।” |