প্রতি বছর বর্ষার মরসুমে অল্প বৃষ্টিতেই জলমগ্ন হয়ে পড়ে খানাকুল-১ ব্লকের চারটি গ্রাম জগন্নাথপুর, জাঁকরি, অমরপুর এবং সারদা। ফলে, ক্ষতির আশঙ্কায় কেউই আমন চাষ করেন না। গ্রামবাসীরা সংসার চালান আলু চাষ করে। কিন্তু রোগ এবং পোকার আক্রমণে এ বার চারটি গ্রামেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে আলু চাষ। মাথায় হাত পড়েছে চাষিদের। তাঁরা ক্ষতিপূরণ হিসেবে শস্যবিমার টাকা চেয়ে প্রশাসনের নানা মহলে তদ্বিরও শুরু করেছেন। সংশ্লিষ্ট সমবায় সমিতির কাছে কৃষিঋণ মকুবের আবেদনও জানিয়েছেন।
আরামবাগের মহকুমা কৃষি আধিকারিক অশ্বিনী কুম্ভকার বলেন, “রোগ এবং পোকার কারণে গোটা মহকুমাতেই আলু চাষে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সেই হিসেব জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠানো হয়েছে। রাজ্য প্রশাসনকেও জানানো হয়েছে। রাজ্য প্রশাসনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
মুণ্ডেশ্বরী নদীর ধার ঘেঁষে ওই গ্রাম চারটি ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেই দুর্গম। প্রতি বছর বন্যা বা বৃষ্টির কারণে আমন চাষে নিশ্চয়তা থাকে না। আলু চাষকে কেন্দ্র করেই জীবিকা নির্বাহ করতে হয় গ্রামবাসীদের। চারটি গ্রামে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ প্রায় ২ হাজার বিঘা।
গ্রামবাসীদের অধিকাংশই গরিব। মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে পুরুষানুক্রমে তাঁরা আলু চাষ করে আসছিলেন। মহাজনের খপ্পর থেকে বের হতে গ্রামবাসীদের উদ্যোগে জগন্নাথপুর গ্রামে ২০০৬ সালে গড়ে ওঠে ‘সুকান্ত সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতি’। সমিতির বর্তমান সদস্য ৫০০ জন। এর বাইরে আরও হাজার খানেক চাষি রয়েছেন বিভিন্ন এলাকায়। তাঁদের জন্য কৃষি দফতর নিখরচায় আলুবীজ, সার দেয়।
কিন্তু সরকারি সাহায্য এবং সমবায় থেকে ঋণ নিয়েও চারটি গ্রামের চাষিরা এ বার আলু চাষ করে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারিতে দু’দফায় বৃষ্টি এবং প্রতিকূল আবহাওয়াকেই এ জন্য দায়ী করেছেন তাঁরা। সমবায় সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে চাষ করেও এ বার ফসল বাঁচাতে পারেননি জগন্নাথপুরের রণজিৎ কোলে, শিশির মাইতি, ধীরাজ পোড়ে, মাধব শাসমলরা। তাঁদের বক্তব্য: ডিসেম্বরের শেষ থেকে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত আলু লাগানো হয়। কিন্তু ইতিমধ্যেই দু’দফায় আবহাওয়া প্রতিকূল হয়ে যায়। গত ১৫ ফেব্রুয়ারির বৃষ্টিতে জল জমে যায় খেতে। সেই জল সহজে বের করা যায়নি। তার পরে দিন কয়েক আকাশ মেঘলা ছিল। তাতে আলুতে নাবিধসা রোগ ধরে। কৃষি দফতরের পরামর্শ মতো তাঁরা ওষুধও প্রয়োগ করেছেন। কিন্তু লাভ হয়নি। মাত্র কিছু উঁচু জমির আলু বেঁচেছে। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে আলুতে জাব পোকার আক্রমণে তাঁদের শেষ আশাও নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
ভাগচাষিদের অবস্থা আরও সঙ্গিন। যেমন, সহদেব খড়ুই এবং সদন্য দলুই দু’জনেই সমবায়ের থেকে ২০ হাজার টাকা করে ঋণ নিয়ে ২ বিঘা করে জমিতে আলু চাষ করেন। তাঁরা বলেন, “একেবারেই সর্বস্বান্ত হয়ে গেলাম। জমির মালিককে কী দেব, সমবায়ের ঋণই বা কী করে শোধ করব, আর সারা বছর নিজের সংসারই বা কী করে চালাব, কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।”
এই অবস্থায় শস্যবিমার টাকার আশায় দিন গুণছেন ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা। এ ব্যাপারে ইতিমধ্যেই তাঁরা গণস্বাক্ষর সংবলিত আবেদনপত্র সংশ্লিষ্ট রামমোহন-১ পঞ্চায়েতের প্রধান, বিডিও এবং মহকুমা কৃষি আধিকারিকের কাছে পাঠিয়েছেন। বিডিও সুপ্রভাত চট্টোপাধ্যায় বলেন, “চাষিদের আবেদন খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
সমবায় সমিতির কাছেও কৃষিঋণ মকুবের আবেদন জানিয়েছেন চাষিরা। কিন্তু সেই আবেদন মানা যে সম্ভব নয়, তা স্বীকার করে নিয়েছেন সমবায়ের কর্তারা। সমবায়ের ডিরেক্টর নিমাইচন্দ্র মাইতি বলেন, “সমবায়ের আর্থিক অবস্থা এমনিতেই ভাল নয়। তার উপরে এ বার আলু চাষের জন্য ৪০ লক্ষ টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে চাষিদের। সেই টাকা পরিশোধ করা না হলে সমবায়ের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়বে। গোটা বিষয়টি আমরা জেলা সমবায় দফতরকে জানাচ্ছি।” সমবায়ের কর্তারাও চান, চাষিদের দ্রুত বিমার টাকা দেওয়া হোক। তা হলে তাঁরা ঋণ শোধ করতে পারবেন। |