ধর্মঘটের অধিকার গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু কোন ধর্মঘট? কেমন ধর্মঘট? একক ভাবে শিল্পসংস্থায় বা একযোগে শিল্পক্ষেত্রের বিভিন্ন সংস্থায় কর্মীরা যদি পরিচালকদের সহিত দর-কষাকষির প্রক্রিয়ায় শেষ অস্ত্র হিসাবে যথার্থ এবং পর্যাপ্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে কর্মবিরতি পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করিবার সমস্ত বিধি অনুসরণ করেন, তাহা হইলে ধর্মঘট যুক্তিযুক্ত হইতে পারে। এ দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্মঘট এই শর্তগুলি মান্য করে না, বিশেষত কর্মীদের মত যাচাইয়ের বা যথার্থ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করিবার কোনও রীতি নাই। ধর্মঘট সচরাচর দলীয় রাজনীতির কর্মসূচি হিসাবেই পালিত হয়, কর্মীরা অধিকারহীন অনুসারী বা নিরুপায় আজ্ঞাবহ মাত্র। এই অন্তর্নিহিত অগণতান্ত্রিকতাই চরমে পৌঁছয়, যখন ধর্মঘট পর্যবসিত হয় ‘সাধারণ ধর্মঘট’-এ, কার্যত যাহা ‘বন্ধ’-এর নামান্তর। সাধারণ ধর্মঘটের সাধারণত্ব এইখানেই যে, জনজীবন স্তব্ধ করিয়া দেওয়াই তাহার লক্ষ্য। এই কারণেই তাহা মজ্জায় মজ্জায় অ-গণতান্ত্রিক। পশ্চিম দুনিয়ার গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে সাধারণ ধর্মঘট অনেক কাল আগে অচল হইয়া গিয়াছে, ইউরোপে সাম্প্রতিক কালে যে সব ধর্মঘটে জনজীবন অচল হইয়াছে, তাহাও মূলত পরিবহণ ধর্মঘট।
ভারত ভিন্ন ঠাঁই। এক কালে বামপন্থী মানসিকতায় প্রভাবিত ব্রিটেনে সাধারণ ধর্মঘটের মহিমা এবং স্বদেশের গাঁধীবাদী হরতালের গৌরব, দুইয়ের সম্মিলিত ক্রিয়ায় এ দেশে সব কিছু স্তব্ধ করিয়া দিবার রীতি প্রচলিত হয়, ঔপনিবেশিক শাসকের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের অস্ত্র হিসাবে তাহার পক্ষে নৈতিক যুক্তিও ছিল। ভারতের দুর্ভাগ্য, স্বাধীনতা আসিলেও সেই রীতির অবসান ঘটে নাই, বামপন্থী দলগুলি সেই অস্ত্র সাদরে বরণ করিয়া লইয়াছে। একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকেও তাহা ব্যবহার করিতে ক্লান্তি নাই, লজ্জাবোধও নাই। বিবিধ রাজনৈতিক দাবিদাওয়ার তালিকা প্রস্তুত করিয়া সাধারণ ধর্মঘটের আয়োজনই আজও বামপন্থীদের বিচারে মহত্তম রাজনৈতিক কর্মসূচি। সচরাচর এই কর্মসূচির আয়োজক হিসাবে ট্রেড ইউনিয়নগুলিই আসরে অবতীর্ণ হয়। উহা দলতন্ত্রের এক লীলামাত্র। তবে এই লীলায় একটি বিশেষ সুবিধা পাওয়া যায় অন্য দলের অনুসারী ট্রেড ইউনিয়নগুলিও শ্রমিক-কর্মীদের মধ্যে আপন প্রতিপত্তি বজায় রাখিবার দায়ে কর্মবিরতিতে সায় দিতে বাধ্য হয়। জনজীবন অচল করিয়া নেতি-র রাজনীতি করিবার কৌশলটি বামপন্থীরা চমৎকার রপ্ত করিয়াছেন বটে।
গত তিন দশক যাবৎ পশ্চিমবঙ্গ ছিল তাঁহাদের এই কৌশল সিদ্ধ করিবার মহাতীর্থ। স্বাভাবিক। সরকারি প্রশাসন হাতে থাকিলে ধর্মঘট সম্পূর্ণ সফল করিয়া দেওয়া ছেলেখেলা বই কিছু নয়। সম্পূর্ণ সফল ধর্মঘটের রীতি বামফ্রন্টের পশ্চিমবঙ্গে এমনই সুপ্রচলিত হইয়াছিল যে বিরোধী দল, এমনকী নিতান্ত প্রান্তিক কোনও দল ধর্মঘট বা বন্ধ ডাকিলেও তাহা সফল হইয়া যাইত। রাজ্যের মানুষ দীর্ঘ অভ্যাসে এই রীতিতে অভ্যস্ত হইয়াছিলেন। আশার কথা, নূতন সরকার প্রথম সাধারণ ধর্মঘট তথা বন্ধ-এর সম্মুখীন হইয়া এই অভ্যাসে গা ভাসাইতে অসম্মত হইয়াছে। মুখ্যমন্ত্রী বিরোধী নেত্রী থাকিতেই যে বন্ধ-বিরোধী অবস্থান লইয়াছিলেন, আগামী কালের প্রস্তাবিত ধর্মঘটের মোকাবিলাতেও সেই অবস্থানে অবিচল থাকিয়াছেন। বিশেষত, সরকারি কর্মীদের কাজে আসিবার জন্য কঠোর অনুশাসন জারি হইয়াছে। সব অনাচার মানিয়া লইতে অভ্যস্ত প্রশ্রয়ী পশ্চিমবঙ্গে এমন কঠোর অবস্থান অনেকের চোখেই কিঞ্চিৎ বিসদৃশ ঠেকিতে পারে, কিন্তু তাহা অভ্যাসের দোষ। আশা করা যায়, মুখ্যমন্ত্রী এই অবস্থানে অবিচল থাকিবেন, কেবল আগামী কাল নহে, ভবিষ্যতেও। যদি তাহা পারেন, তবে হয়তো সুদীর্ঘ অচলাবস্থার অবসানের সূচনা হইতে পারে। তেমন দিন কি কখনও আসিবে? ভাবিতেও ভয় হয়। আপাতত আগামী কালের পরীক্ষা কেমন হয়, দেখা যাক। |