করাত কল বিতর্কে কার্যত ‘কোণঠাসা’ রাজ্যের প্রধান মুখ্য বনপাল (পিসিসিএফ) মির্জা আসগর সুলতান। সেই সঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আড়াই সপ্তাহের মাথায় নতুন পদ (পিসিসিএফ, জেনারেল) তৈরি করে বাড়তি দায়িত্ব দেওয়া হল অতনু রাহাকে।
সরকারি সূত্রের খবর, শনিবার বিকেল পর্যন্ত মহাকরণে একাধিক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্মতিক্রমে এম এ সুলতানের দায়িত্ব কমিয়ে তা অতনুবাবুকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বন দফতর সূত্রের খবর, নতুন পদে নিযুক্ত অতনুবাবুকে বন-প্রশাসন ও বাজেট বিষয়ক যাবতীয় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। করাত কলের ভবিষ্যত কী, সে বিষয়েও সিদ্ধান্ত তিনিই নেবেন। গত ৭ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে অতনুবাবুকে সরিয়ে বন দফতরের সর্বোচ্চ পদে যাঁকে রাজ্য বসিয়েছে, সেই এম এ সুলতানকে অন্য পিসিসিএফদের মধ্যে সমন্বয় সাধন-সহ বেশ কিছু দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
 |
হিতেন বর্মন |
 |
এম এ সুলতান |
এই ঘটনায় বন মহলে তো বটেই, মহাকরণেও চলছে নানা জল্পনা। বন অফিসারদের একাংশ মনে করছেন, ‘বেআইনি’ করাত কল বন্ধ করার ব্যাপারে বনমন্ত্রী হিতেন বর্মন যে ‘ধীরে চলো’ নীতি নিয়েছেন, তাতে কার্যত ‘সিলমোহর’ দেওয়া হল। কার্যত স্থগিত হয়ে গেল ‘বেআইনি’ করাত কল বন্ধ করার প্রক্রিয়া। একই সঙ্গে কোনও বিষয়ে মন্ত্রীর নির্দেশ অমান্য করে প্রকাশ্যে মুখ খুললে তা যে ‘বরদাস্ত’ করা হবে না, সেই বার্তাও ফের দেওয়া হল। উল্লেখ্য, কিছু দিন আগে বিভাগীয় মন্ত্রীর সঙ্গে ‘বিরোধে’ জড়িয়ে পড়ায় কারা দফতরের এক আইজি-কেও পদ থেকে সরানো হয়।
বনমন্ত্রী এ দিন বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী আমার কাছে বিশদে ঘটনার কথা জানতে চান। আমি সব বলেছি। পিসিপিএফ আমাদের না জানিয়ে করাত কলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে এবং সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলে ‘সার্ভিস রুল’ বা চাকরির নিয়ম-বিধি ভঙ্গ করেছেন।” এম এ সুলতান অবশ্য বলেন, “আমি কোথাও সরকারি নিয়মনীতি ভাঙিনি। শুধু কেন্দ্রীয় বন মন্ত্রকের নীতি রূপায়ণ করতে গিয়েছিলাম।” তাঁর বক্তব্য, কেন্দ্রীয় নিয়ম অনুসারে বনভূমির পরিমাণ হওয়া উচিত রাজ্যের মোট এলাকার ৩৩ শতাংশ। অথচ পশ্চিমবঙ্গে বনভূমি ১৬ শতাংশের কম। বেআইনি করাত কল বন্ধ করে সেই সামান্য সবুজটুকু রক্ষা করতে চাইছিলেন তিনি। সুলতানের ক্ষোভ, সরকারি নীতি রূপায়ণ করতে গিয়েই তাঁকে বনমন্ত্রীর ‘কোপের মুখে’ পড়তে হয়েছে।
বন অফিসারদের একাংশের মতে, এই ঘটনায় ‘স্বচ্ছ ও দুর্নীতি মুক্ত’ প্রশাসন গড়ার বিষয়টি কিছুটা হলেও ধাক্কা খাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, এম এ সুলতান বন বিভাগের সর্বোচ্চ পদে বসার পরে একই জায়গা দীর্ঘ দিন ধরে থাকা অফিসারদের বদলির প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। পাশাপাশি, রাজ্য জুড়ে বিনা লাইসেন্সে চলা করাত কল বন্ধের কাজে গতি আনার চেষ্টা করছিলেন। বন অফিসার-কর্মীদের অনেকেই জঙ্গল বাঁচাতে ওই কাজে সামিল হয়েছিলেন। কিন্তু খোদ বনমন্ত্রী তা নিয়ে ‘তাড়াহুড়ো’ করতে রাজি হননি। বরং অভিযান না করার জন্য সুলতানকে নির্দেশ দেন। সে কথা না শুনে বনমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ জানানোর প্রস্তুতি নেন পিসিসিএফ তিনি। তা নিয়ে হইচই শুরু হওয়ায় আসরে নামতে হয় খোদ মুখ্যমন্ত্রীকে। কিন্তু, তার জেরে ফের অতনুবাবু ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছনোয় যে অফিসার-কর্মীরা অভিযানের গতি বাড়ানোর চেষ্টা শুরু করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই শঙ্কিত।
করাত কল নিয়ে বন দফতরের মধ্যে বিতর্ক অবশ্য নতুন কিছু নয়। রাজ্যে দু’ধরনের করাত কল রয়েছে। যে করাত কলে বড় গুঁড়ি কেটে ছোট করে সরবরাহ করা হয়। তাদের ‘প্রাইমারি করাত কল’ বলে। আর সেই চেরাই কাঠ থেকে আসবাব-সহ অন্যান্য জিনিস যে করাত কলে বানানো হয়, তাদের ‘সেকেন্ডারি করাত কল’ বলে। প্রাথমিক বা বড় করাত কলের লাইসেন্স দেয় কেন্দ্রীয় সরকার।
ছোট করাত কলের লাইসেন্স রাজ্য সরকার দিলেও তাতে কেন্দ্রীয় বন বিভাগের অনুমোদন লাগে।
বন দফতর সূত্রের খবর, এই দু’ধরনের প্রায় ৩০০০ করাত কলের আবেদনপত্র জমা পড়েছে। এর মধ্যে ৬৫০টি কলকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ১৬২১টি করাত কল অনুমোদন পাবে ধরে নিয়ে চলছে। এই লাইসেন্স বিহীন করাত কলগুলিই বন্ধ করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন সুলতান। অন্য দিকে বনমন্ত্রীর দাবি ছিল, এই কলগুলি কিছু দিনের মধ্যেই লাইসেন্স পাবে।
নিয়ম হল, করাত কলের লাইসেন্স না-দিলে তা আবেদনকারীকে জানিয়ে দিতে হবে। করাত কল মালিকদের সংগঠনের দাবি, প্রায় দেড় দশক ধরে আবেদনকারীদের সরকারি তরফে কিছুই জানানো হয়নি।
আবার কল বন্ধ করার জন্য বন দফতর কোনও নির্দেশও দেয়নি। ফলে, এই করাত কলগুলি রমরমিয়ে চলছে। যাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে প্রায় ২ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান যুক্ত।
বন মহলের অনেকেরই বক্তব্য, করাত কল মালিকদের একটি বড় অংশ এত দিন বামেদের ‘ছত্রচ্ছায়ায়’ থাকলেও রাজ্যে ক্ষমতা বদলের পরেই শিবির বদলে ফেলেছেন। ফলে, তাঁদের করাত কলে যুক্ত মানুষেরাও ওই শিবিরের আশ্রয়ে চলে গিয়েছেন। সে দিক থেকে দেখলে বন দফতর বেআইনি করাত কল বন্ধে কড়াকড়ি করলে আগামী দিনে পঞ্চায়েত ভোটে তার প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে তৃণমূলের নেতাদের একাংশের। জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সেই বার্তা যায় বনমন্ত্রীর কাছেও। বনমন্ত্রী পিসিসিএফ-কে সাফ জানিয়ে দেন, তিনি এই মুহূর্তে করাত কল বন্ধের অভিযান করতে দেবেন না।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গিয়েছে, এই অবস্থায় শুক্রবার রাতে হিতেনবাবুকে জরুরি ভিত্তিতে ডেকে পাঠান মুখ্যমন্ত্রী। রাত ১১টা নাগাদ সড়ক পথে কোচবিহার থেকে মালদহে পৌঁছন হিতেনবাবু। ভোরে জনশতাব্দী এক্সপ্রেস ধরে হাওড়া পৌঁছে মহাকরণে যান।
সেখানে তিনি গোটা বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রী জানান। তাতে আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটের বিষয়টিও তোলেন বলে একটি সূত্রে জানা গিয়েছে। তার পরেই মুখ্যসচিব সমর ঘোষের সঙ্গে বৈঠকে বসেন বনসচিব সুবেশ দাস। কয়েক দফায় বৈঠকের পরে নতুন পদ তৈরি করে অতনুবাবুকে নিযুক্ত করা হয়। |