পার্ক স্ট্রিট, বরাহনগরের পরে কেতুগ্রাম। মেয়ের মাথায় বন্দুক ধরে মাকে ট্রেন থেকে নামিয়ে ধর্ষণ করল দুষ্কৃতীরা।
শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ বর্ধমানের কেতুগ্রাম থানার পাচুন্দি ও অম্বলগ্রাম স্টেশনের মাঝে এই ঘটনা চোখের সামনে দেখে ভয়ে শিউরে ওঠেন ৫২৩৫৬ ডাউন কাটোয়াগামী আমোদপুর লোকালের বাকি যাত্রীরা। তেমনই এক যাত্রী কাটোয়া স্টেশনে পৌঁছে প্রথম রেলপুলিশকে ঘটনাটি জানান। পরে পুলিশ ধর্ষিতার বাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলে। শনিবার গভীর রাতে মহিলাকে আনা হয় কাটোয়া স্টেশনে। সেখানে রেলপুলিশের কাছে ধর্ষণের লিখিত অভিযোগ করেন ওই মহিলা। রাতেই কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালে তাঁর ডাক্তারি পরীক্ষা হয়।
ঘণ্টায় ১৫ কিলোমিটার বেগে চলা চার কামরার ওই ট্রেন এলাকায় ‘ছোট রেল’ বলেই পরিচিত। পাচুন্দি স্টেশন ছাড়িয়ে গোমাই গ্রামের কাছে ঘটনাটি ঘটে। জানা গিয়েছে, জনা আটেক দুষ্কৃতীর মধ্যে চার জন ট্রেনের চালক ও গার্ডকে আটকে রাখে। বাকিরা প্রথমে অবাধে লুঠপাট চালায়। বন্দুক, পিস্তল, ভোজালির সামনে প্রতিবাদ করার সাহস পাননি কোনও যাত্রীই। তখনই সোনার দুল লুকিয়ে ফেলার ‘অপরাধে’ ওই মহিলার বাঁ গালে ভোজালি দিয়ে আঘাতও করা হয়। তার পরেই তাঁকে রেললাইনের পাশের ঝোপে টেনে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে তারা।
ট্রেনটি কাটোয়া স্টেশনে ঢোকার পরে প্রথমে রেলপুলিশের কাছে ডাকাতির অভিযোগ দায়ের করেন যাত্রীরা। এক জন যাত্রী রেল পুলিশকে ধর্ষণের ঘটনাটিও জানান। তখনও পর্যন্ত ধর্ষিত মহিলার পরিচয় জানতে পারেনি রেলপুলিশ। পরে তাঁকে চিহ্নিত করা হয়। জানা যায়, যেখানে ঘটনাটি ঘটেছে, তার কাছেই একটি গ্রামে বাড়ি বছর উনত্রিশের ওই বিধবা মহিলার। সেলাই ও কাঁথা স্টিচের কাজ করে সংসার চালান তিনি। এ দিনও বীরভূমের কীর্ণাহারে মহাজনের কাছে কাপড় বিক্রি করে গ্রামের বাড়িতে ফিরছিলেন। সঙ্গে ছিল ১১ বছরের ছোট মেয়ে।
ঘটনার কথা জেনে কাটোয়ার এসডিপিও ধ্রুবজ্যোতি দাস, আইসি (কেতুগ্রাম) রঞ্জন সিংহ এবং রেলপুলিশের বাহিনী ওই গ্রামে গিয়ে মহিলার সঙ্গে বিশদে কথা বলেন। রেলপুলিশের ডিজি দিলীপ মিত্র পরে বলেন, “ঘটনার গুরুত্ব বুঝে আমি নিজে রবিবার কাটোয়ায় যাচ্ছি। দোষীদের দ্রুত চিহ্নিত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রেলপুলিশকে।” রেলপুলিশের পাশাপাশি কাটোয়া ও কেতুগ্রাম থানার পুলিশও অপরাধীদের সন্ধানে নেমেছে।
কী ভাবে ঘটে গেল এই ঘটনা? রেলপুলিশ ও যাত্রী-সূত্রে জানা যাচ্ছে, দুষ্কৃতীরা সংখ্যায় জনা আটেক ছিল। চার জন ছিল ওই মহিলার কামরায়। বাকিরা গার্ডের কামরায়। ওই কামরাতেও যাত্রীরা ছিলেন। দুষ্কৃতীরা প্রথমেই গার্ডকে বলে, ‘ট্রেন থেকে বাচ্চা পড়ে গিয়েছে। ট্রেন থামাতে হবে।’ গার্ড দিলীপকুমার সরকার তা শুনে মোবাইলে ফোন করেন চালক মানিক প্রধানকে। মানিকবাবু ফোন না ধরায় ডাকাতেরা দিলীপবাবুর মাথায় বন্দুকের নল ঠেকিয়ে হুকুম দেয় ট্রেন থামাতে। আতঙ্কে যাত্রীরা তখন দিশাহারা। দিলীপবাবু ইতস্তত করতে থাকায় ডাকাতেরা তাঁকে জোর করে ট্রেন থেকে নামানোর চেষ্টা করে। এর পর দিলীপবাবু ওয়াকিটকিতে চালককে ঘটনা জানান। ট্রেন থামে। ডাকাতেরা গার্ড, চালক ও সহকারী চালককে ট্রেন থেকে নামিয়ে পাশেই আটকে রাখে। কেড়ে নেয় তাঁদের দু’টি ওয়াকিটকিও। তার পর শুরু হয় যাত্রী কামরায় লুঠতরাজ।
শনিবার রাত ১২টা নাগাদ কাটোয়া স্টেশনে পুলিশের সামনে বসে ধর্ষিতা মহিলা বলেন, “আমরা দ্বিতীয় কামরায় ছিলাম। গোমাই গ্রামের কাছে অন্ধকারে ট্রেনটা হঠাৎ থেমে গেল। কামরায় বসে থাকা চারটে লোক অস্ত্রশস্ত্র বার করে যাত্রীদের বলল, ‘যার কাছে যা আছে দিয়ে দে’। প্রথমেই ওরা আমার গলার ইমিটেশনের হার টেনে নিয়ে নেয়। তার পরে বলে ‘কীর্ণাহার থেকে দেখেছি তোর কানে সোনার দুল ছিল। কোথায় রেখেছিস?’ দুলটা ব্লাউজের ভিতরে রেখেছিলাম। আমি মুখ না খোলায় ওরা মারধর করে। ভোজালি দিয়ে বাঁ গালে মারে। দুলও কেড়ে নেয়।”
এই দৃশ্য দেখে ওই মহিলার ছোট মেয়ে চিৎকার করতে শুরু করায় দুষ্কৃতীদের এক জন তার মাথায় বন্দুক ধরে। মহিলার হাত ধরে আর এক জন টেনে নিয়ে যায় লাইনের পাশের ঝোপে। সেখানে তাদের মধ্যে এক জন তাঁকে ধর্ষণ করে বলে মহিলার অভিযোগ। তাঁর কথায়, “লোকটার বয়স তিরিশ-বত্রিশ। পাঁচ ফুট সাত-আট ইঞ্চির মতো লম্বা। গায়ে কালো জামা, প্যান্ট। ও আমার উপরে অত্যাচার করার পরে ওর আর এক সঙ্গী আমাকে চেপে ধরেছিল। তখনই আমার মেয়ে চিল-চিৎকার করে ওঠে।” যাত্রীরা জানান, গার্ডকে ট্রেন ছাড়তে বলে দুষ্কৃতীরা তখন পালিয়ে যায়। আধঘণ্টার ‘অপারেশন’ সেরে চলে যাওয়ার আগে অবশ্য ফিরিয়ে দিয়ে যায় ওয়াকিটকি দু’টি। ওই ট্রেনে চেপেই বাড়ি ফেরেন বিধ্বস্ত মহিলা ও অন্য যাত্রীরা।
রাতে তাঁর সঙ্গে পুলিশের কাছে এসেছিলেন তাঁর জা ও ভাসুর। ওঁরা জানান, নির্যাতিতার স্বামী ছ’বছর আগে মারা গিয়েছেন। মহিলার দুই মেয়ে। বড় জনের বয়স চোদ্দো। জা বলেন, “কেন ওই জানোয়ারগুলো এই সর্বনাশ করল? দোষীদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ধরে সাজা দিক পুলিশ।” তাঁদের সঙ্গী, কেতুগ্রাম ২ ব্লক তৃণমূল সভাপতি বিকাশ মজুমদার বলেন, “ভয়ঙ্কর ঘটনা! পুলিশ ও রেলপুলিশ কর্তৃপক্ষকে যত দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছি।” |