আকাশের কাছাকাছি
চুপচাপ একটা বসন্ত-বিকেল, আওয়াজ বলতে শুধু নরম হাওয়া আর পাতাদের শেষ লুকোচুরি খেলার আওয়াজ, আশপাশের সব কিছুই কেমন যেন ডিসিপ্লিন মেনে হচ্ছে, গাড়ির অস্থির হর্নাহর্নি নেই, গলা চড়িয়ে দরদাম নেই, যে যার নিয়ম ও সময় মতো চলে যাচ্ছে। এমন আশ্চর্য সব ব্যাপার হামেশাই যেখানে ঘটে, সে জিয়োগ্রাফিকাল পয়েন্ট-এর নাম ম্যাকলয়েডগঞ্জ। হিমাচলের ধর্মশালায় তো নিশ্চয়ই বার তিনেক ছুটি কাটানো হয়ে গিয়েছে, এ বার তাই বসন্তটা, আর একটু এগিয়ে ম্যাকলয়েডগঞ্জ-এ কাটান। অনবদ্য লাগবে, বুকে হাত রেখে বলছি।
ধর্মশালায় ইদানীং বই মেলার মতো ভিড় হচ্ছে, গেলেই পুরনো টিউশনের বন্ধু আর বড় মামার শালার সঙ্গে দেখা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ভরসা একটাই, এঁদের বেশির ভাগই আর দু’পা হেঁটে ম্যাকলয়েড-এর দিকে আসেন না। মিস করেন। তবে একটা কথা, ম্যাকলয়েডগঞ্জ যদি উপভোগ করতেই হয়, তা হলে ‘সাইটসিন’-এর শিডিউলে ফেললে হবে না। কারণ শামিয়ানা খাটিয়ে প্রদর্শন করার মতো তেমন কিছুই নেই ম্যাকলয়েডগঞ্জ-এর। তাক লাগানো সৌন্দর্য খুঁজে নিতে হবে আপনাকেই। গাছের ফাঁকে, রাস্তার ধারে, রোদ্দুরের কাছে। একটু বেশি বানানো মনে হচ্ছে কি? এক বার গিয়ে পড়লে আর মনে হবে না।
ভাইসরয় লর্ড এলগিন-এরও অনেকটা এমনই অবস্থা হয়েছিল। ভারতে এসে তো গরমের ঠেলায় তিতিবিরক্ত, কিন্তু এক বার এ অঞ্চলে ট্যুর-এ এসে, এমন চমকে গেলেন, যে তাঁকে আর ওখান থেকে ফেরানোই যায় না। বললেন, এ তো দেখছি এক্কেবারে স্কটল্যান্ড-এর মতো... আরও বললেন, জলদি এই জায়গাকে গ্রীষ্মকালীন রাজধানী করা হোক...
গ্রীষ্মকালীন ক্যাপিটাল করা হয়নি, সে শিরোপা যায় শিমলার কাছে, আর এ সবের মধ্যেই এলগিনও শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন। এখানেই। কিন্তু সবার মনে রয়ে গেল এলগিন-এর সেই মন্তব্য: ‘স্কটল্যান্ড-এর মতো...’ ফলে গাউন পরা মিষ্টি মিষ্টি মেমরা প্রায়ই ঘুরে বেড়াতে লাগলেন এ গলি ও গলি। জাতে উঠে এল এ প্রান্ত। তখনও অবশ্য এ জায়গাকে লোক ম্যাকলয়েডগঞ্জ নামে চিনত না। ধর্মশালার একটি ছোট্ট অংশ হিসেবেই তখন তার কাটতি।
পপুলারিটি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিয়ম মেনে এল একটা নাম। সেটা দেওয়া হল পঞ্জাবের গভর্নর ডোনাল্ড ম্যাকলয়েডকে সম্মান জানিয়ে। ব্রিটিশরা দেশ ছাড়ার সঙ্গে এই ম্যাকলয়েডগঞ্জও কিছুটা জৌলুস হারায়। সেটি আবার ফিরে আসে নতুন চেহারায়, ১৯৬০ নাগাদ, যখন ভারত সরকার দলাই লামাকে এখানে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়। সেই থেকে এটি তিব্বতিদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা।
ম্যাকলয়েডগঞ্জকে তাই অনেক সময়ই ‘লিটল লাসা’ বলেও ডাকা হয়। ৬,৮৩০ ফুট উঁচু এই ছোট্ট শহরের আনাচকানাচ ভরে আছে তিব্বতি সংস্কৃতির টুকরোয়। মোমো থেকে খাঁটি বৌদ্ধ পুঁথি, সবই পাবেন এখানে। অবশ্যই ঘুরে আসবেন সুগলাগখাং বা দলাই লামার মন্দির। শাক্যমুনি, অবলোকিতেশ্বর ও গুরু রিনপোশে’র মূর্তি আপনাকে চমকে দেবেই। গ্যারান্টি। বেরিয়ে এক বার ঢুঁ মেরে নিন ‘নাম’ আর্ট গ্যালারিতে, কাছেই পাবেন ‘পিক’ আর্ট গ্যালারিও। পিক গ্যালারিতে অনেক সময়ই কবিতার আসর বসে, ও ভাবেও মন চাঙ্গা করে নিতে পারেন।
এই সব করতে করতে পাহাড়ে রাত ঢলে পড়বে। জমে যাবে, যদি একটা ছোট্ট টিলা গোছের জায়গায় একটু আগুন জ্বালিয়ে বসতে পারেন। ভাবুন তো এক বার, আপনার ডাইনে-বাঁয়ে-পিছনে জমাট অন্ধকার, শুধু পায়ের কাছটায় উষ্ণতার রেশ, আর দূউউরে, ঢালু পেরিয়ে চিকমিক করছে শহরের আলো। একটা ঘোর আসবেই। একটা বুদ্বুদ, যেন। যা না ভাঙলেই ভাল, কিন্তু ভেঙে তো যাবেই!
আর ভেঙে যখন যাবেই, তখন মুখ ব্যাজার করে কী লাভ, বরং বেরিয়ে পড়ুন, আর একটা বুদ্বুদ ফুটিয়ে তুলতে। সে বুদ্বুদ আপনি পাবেন ফরসাইথগঞ্জ-এ। ম্যাকলয়েডগঞ্জ থেকে জাস্ট কিছুটা এগিয়ে। ফরসাইথগঞ্জ আরও চুপচাপ। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বানানো রাস্তা আপনাকে নিয়ে যাবে অনেক দূর, হয়তো সেই পুরনো এলগিন-জমানায়ও পৌঁছে যেতে পারেন।
পাতার খসখসের ওপর হাঁটতে হাঁটতে যেখানে এসে থমকাবেন, সেটি একটি চার্চ। নামটা ভারি চমৎকার, সেন্ট জন ইন দ্য ওয়াইল্ডারনেস। ওই যে আপনার বুদ্বুদের শুরু। নিয়ো-গথিক স্টাইল-এ তৈরি এই পাথরের চার্চের বয়স প্রায় ১৬০ বছর। ঘষা বেলজিয়ান কাচের জানলাগুলো এখনও সেই পুরনো সময় আঁকড়ে রেখে দিয়েছে। সেই মুহূর্ত আরও গভীর হবে, পাশের কবরস্থানের দিকে এগোলে। এইখানেই তো আছে লর্ড এলগিন-এর মেমরিয়াল।
ফেরার সময় দেখবেন গ্যাস বুকিংয়ের ডেট, অফিসের ব্যাকলগ ফাইল, মিনিবাসের কন্ডাক্টরের সেই অসহ্য ব্যবহার, কিছুই আর স্মৃতিতে নেই। মন তখন এক্কেবারে অন্য এক প্লেনে। অনেকটা রাহুল দ্রাবিড় টাইপ। যে জানে, যে বাউন্সার তো মুখের ওপর ছুটে আসবেই, পৃথিবীর নিয়ম। তা বলে কি খিটখিটে হয়ে যাব? না। নিজেকে নিজের থেকে একটু সরিয়ে নিয়ে গেলেই, আবার ধাতস্থ হয়ে যাব। ম্যাকলয়েডগঞ্জ আপনাকে সেই স্থিরতা দেবে। একটা আশ্বাস, যে সবই ঠিক আছে, তুমি জাস্ট খেলে যাও প্রাণ খুলে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.