|
|
|
|
|
মাটির মানুষ |
জ্যোতির্বিজ্ঞানের অজানা
তথ্য খুঁজতে ব্যস্ত রণতোষ
অশোককুমার কুণ্ডু • বারাসত |
|
দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা কোনও দিন সে অর্থে আলোকবৃত্তে আসেননি।
অথচ, তাঁরা গোটা জীবন ধরে জেলার মনন এবং সাংস্কৃতিক মানচিত্রকে রঙিন করে তুলেছেন।
মাটি থেকে উঠে আসা সেই সব মানুষের কথা। |
বিজ্ঞানের অধ্যাপক। দেশ ভাগের ফলে পাঁচের দশকে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান থেকে উত্তর চব্বিশ পরগনার বারাসতে। সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে বিএসসি। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এমএসসি। ছয়ের দশকে কর্মক্ষেত্র বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর রামানন্দ কলেজ। পরে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে অধ্যাপক হিসাবে অবসর। এর মাঝে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি। দেশি বিদেশি পত্রিকায় অনেক লেখালেখি। বাংলা ভাষায় এক ডজনেরও বেশি বিজ্ঞানীদের ওপর গ্রন্থ প্রকাশনা। এত কাজের মধ্যে অবশ্য রণতোষ চক্রবর্তী বিস্ময় ঘটিয়েছেন অন্যখানে।
সেটা কোনখানে?
পল্লি-বিজ্ঞানী রাধাগোবিন্দ চন্দ্রকে (১৮৭৮-১৯৭৫) খুঁজে বের করে ভারতের জ্যোতির্বিজ্ঞানের আকাশে তাঁর পরিচয় ঘটিয়েছেন। মানুষকে চিনিয়েছেন কে এই রাধাগোবিন্দ? প্রয়াত এই বিজ্ঞানীকে খুঁজে বের করার কাহিনী শোনা গেল রণতোষের কাছে, “বারাসতে ‘সত্যভারতী’-র অফিসে পড়ে থাকা একটি দূরবীন দেখে খোঁজ নিই, কে এটা ব্যবহার করতেন? প্রয়াত জ্যোতির্বিজ্ঞানীর বাড়িতে খোঁজ করতে গিয়ে পেয়ে যাই মূল্যবান তথ্য।”
কী সেই তথ্য?
|
নিজস্ব চিত্র। |
জানা গেল, রাধাগোবিন্দ এন্ট্রান্স পাশ করতে পারেননি। জন্ম যশোহরের বগচর গ্রামে। যশোহর কালেক্টরটে পনেরো টাকার চাকরি। অক্ষয়কুমার দত্তের লেখা ‘ব্রহ্মাণ্ড কী প্রকাণ্ড’ পড়ে, স্কুলেই আকাশচর্চার শুরু। ৯৭ বছর বয়সেও সে চেষ্টায় ছেদ পড়েনি। ১৯১০ সালে খালি চোখে হ্যালির ধূমকেতু পর্যবেক্ষণ করে শান্তিনিকেতনে জগদানন্দকে চিঠি। জগদানন্দের উপদেশে সেই যুগে, বাংলাদেশের ওই গ্রামে বসে রাধাগোবিন্দ বিলেত থেকে আনালেন ১৬০ টাকার একটি দূরবীন। “সেই দূরবীন আমার হাতে পড়ে এবং গোটা ব্যাপারটা খুঁজতে গিয়ে দেশ-বিদেশে রাধাগোবিন্দর আকাশচর্চার যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করি। ভারত ভাগে চলে এসেছিলেন যশোহর ছেড়ে পানিহাটি। সেখান থেকে বারাসত নবপল্লি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আকাশচর্চায় তাঁর ছেদ পড়েনি।” জানালেন রণতোষ।
ভাঙা পোটমান থেকে রাধাগোবিন্দর বিদেশি সম্মানের কাগজপত্র, রাধাগোবিন্দর অখণ্ড ও খণ্ড ভারতের গ্রামে বসে ভ্যারিয়েবল (যাদের ঔজ্জ্বল্য বাড়ে-কমে) স্টারের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ পৌঁছে যেত আমেরিকার হার্ভার্ড অবজারভেটরিতে। পর্যবেক্ষণের গভীরতা বুঝে তাঁকে সদস্য করে দেওয়াও হয়। ১৯১৮ সাত জুন, আকাশে যে ‘নোভা’টি দেখেন, তা তিনিই প্রথম দেখেন বলে জগদানন্দের মত। রাধাগোবিন্দই প্রথমে পদক পান ভারতে, ১৯২৮ সালে। ফরাসি সরকার ‘অফিসার দ্য অকাডেমিক রিপাবলিক ফ্রান্সেস’ রাধাগোবিন্দকে দেন। আরও কত চিঠিপত্র, প্রশংসাপত্র নিয়ে, ‘জ্যোতির্বিজ্ঞানী রাধাগোবিন্দ’, বাংলা ভাষায় প্রকাশ করেন রণতোষ।
রামানন্দ কলেজে অধ্যাপনা করতে গিয়ে ফের আর এক আবিষ্কার রণতোষের। ‘সিদ্ধান্ত দর্পন’ গ্রন্থের মূল্যবান ভূমিকা। লিখেছেন যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধী। এক ওড়িশাবাসী। যিনি অ্যাস্ট্রোনমির চর্চা করেছিলেন জীবনভর। ভুবনেশ্বর থেকে শতাধিক কিলোমিটার দূরে বসে গ্রহ নক্ষত্রের সময় ও অবস্থান (এর সঙ্গে ‘ভাগ্য-ফল’ মেলানো নয়) নিয়ে পড়ে থেকেছেন। চন্দ্রশেখর সামন্ত (১৮৩৫-১৯০৪) উল্লেখযোগ্য কাজ করেছিলেন। গ্রামের নাম খণ্ডপাড়া। কথা বলতে বলতে উত্তেজিত রণতোষ, “অপেক্ষা করতে পারিনি। একজন মানুষ প্রত্যন্ত এক গ্রামে বসে, কাঠের যন্ত্রপাতি তৈরি করে গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান বুঝতেন। এটা যে কাউকে অবাক করে দেওয়ার মতো। সংস্কৃত ভাল জানতেন। আর মাতৃভাষা ওড়িয়া সম্বল করে কি বিপুল কাজ করেছেন ভাবা যায় না।’’
নানা জায়গায় ছড়িয়ে থাকা এমন সব মূল্যবান সম্পদের প্রতি ব্যাকুলতাই পরিচিতি দিয়েছে রণতোষবাবুকে। আর সেই পরিচিতির তাগিদেই দেশের বিজ্ঞানীদের জীবন ও কাজকর্ম নিয়ে রণতোষ একের পর এক গ্রন্থ প্রকাশ করে চলেছেন। যা আগামী দিনের এক মূল্যবান সম্পদ। |
|
|
|
|
|