|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
‘পঞ্চবটী’ কেন হয়ে যায় ‘লক্ষ্মণরেখা’ |
রুশতী সেন |
গল্পসমগ্র ১, অমলেন্দু চক্রবর্তী। দে’জ, ৪০০.০০ |
অমলেন্দু চক্রবর্তীর আকস্মিক মৃত্যুর দু’বছর পরে তাঁর গল্পসমগ্র-র প্রথম খণ্ড বেরোল। এ বইয়ের তিরিশটি কাহিনির নির্বাচন, ক্রমবিন্যাস, পর্যায়-বিভাজন লেখক নিজেই করে গিয়েছিলেন। ওই পর্যায়-বিভাজন বিষয়বস্তুর নিরিখে, নাকি রচনাশৈলীর, সে প্রসঙ্গে নিশ্চিত হদিশ নেই প্রকাশকের কাছে। তেমন কোনও চিন্তাসূত্রের বিস্তৃত খবর না মিললে গল্পসমগ্র-র পরবর্তী খণ্ডগুলি কালানুক্রমেই কাহিনি সাজাবে। এ সব খবর আছে ‘প্রকাশকের নিবেদন’-এ। অমলেন্দুর সাহিত্যসৃজনের প্রায় পুরো বিস্তার জুড়ে বিভিন্ন সময়ে লেখা গল্পগুলির মধ্যে ১৯৫৩-তে লেখকের কুড়ি পুরবার আগে প্রকাশিত সাহানা (শ্রাবণ ১৩৬০ ব.) গল্পসংকলনের সাতটি কাহিনির একটিও নেই। যে গল্পসংকলনের সুবাদে পাঠক প্রথম চিনেছিলেন তাঁকে, সেই অবিরত চেনামুখ (আশা প্রকাশনী, ১৯৭৫, প্রথম দে’জ সংস্করণ, ১৯৮৬)-এর নামগল্পটি ছাড়া আছে আর মাত্র দু’টি কাহিনি ‘অদ্ভুত আঁধারে’, ‘প্রচ্ছন্ন স্বদেশ’ নামে আর ‘কিংবদন্তি’, ‘একটি কিংবদন্তির গল্প’ পরিচয়ে।
প্রথম খণ্ডের ভূমিকা লিখে যেতে পারেননি লেখক। তবে তাঁর সৃজনের সঙ্গে খানিকটা পরিচিত যে পাঠক, তাঁর পক্ষে এই নির্বাচন আর পর্যায়-বিভাজন প্রসঙ্গে কিছু অনুমান অসম্ভব নয়। সেই সূত্রেই গড়ে উঠতে পারে প্রথম খণ্ডের পাঠ, পরেরগুলির জন্য প্রত্যাশা। অনেক আঁধারের বিন্যাসে আখ্যান সাজিয়েও, এই লেখক শেষ পর্যন্ত বলতে চান যে, অন্ধকারই শেষ কথা নয়। তাই কি ‘অদ্ভুত আঁধারে’ নতুন নামে সংকলনের প্রথম গল্প হয়ে ওঠে? অত আঁধার, অত মরণ, অত একাকিত্বের পরে ‘আমি আছি, আমি আছি, আমি আছি...’-র অনুভবে শেষ হয় প্রথম খণ্ডের প্রারম্ভিক কাহিনি। লক্ষ্মীবুড়ি বা গোবর্ধন কাঁড়ার মতো মানুষের কাহিনি লিখবেন বলেই তো সাহানা-র কৈশোর-উত্তীর্ণ লেখকের পরিক্রমা শুরু। কিন্তু চতুষ্পার্শ্বের পৃথিবীটা এমনই বদলাতে থাকে যে, প্রতিবাদ-প্রতিরোধের, জয়-পরাজয়ের সাহিত্যিক গোছটা কেমন আলুথালু হয়ে পড়ে। এ-ভাঙন অমলেন্দু মর্মে মর্মে বুঝতেন। খড়কুটোদের জীবনযাপনে, যন্ত্রণা-বঞ্চনায় আর তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অঙ্গীকারে প্রবল আশার কোনও বার্তা যখন আর তেমন বিশ্বাসযোগ্য থাকে না সাহিত্যিকের নিজেরও কাছে, তখন তিনি বার বার দাঁড়ান কোনও-না-কোনও প্রতীকের দুয়ারে লক্ষ্মী, ভগবতী, কালকেতু, লখিন্দর বা চাঁদ সওদাগর। ‘লক্ষ্মীবুড়ি স্বর্গে যাবে’, ‘আর্য অনুপ্রবেশ এবং গোবর্ধন কাঁড়া’ আর গোলাপবালার কাহিনি ‘অনধিকারে ভূমিস্বত্ব’ সংকলনের একই পর্বে থাকবে, অন্তত অমলেন্দু চক্রবর্তীর বিচারে, এ একান্ত স্বাভাবিক, সংগত। গত শতকের পাঁচের দশকে অমলেন্দুর সৃজনের শুরু। শতক যতই অন্তিম লগ্নের দিকে এগোয়, ততই তিনি দেখেন, আস্থা-বিশ্বাস-আদর্শের আশ্রয়গুলো টাল খেয়ে যাচ্ছে। ওই টাল-খাওয়া বিশ্বাসের সংগতি মেনে নিজেকে, নিজের লেখাকে অমলেন্দু ভাঙতে চান। কিন্তু কোথায় যেন অতখানি নির্মম হতে না-পারার শুভ্রতা ঘিরে ধরে তাঁকে, তাঁর সাহিত্যকে। তবু ১৯৬৫-র ‘অদ্ভুত আঁধারে’ থেকে ২০০৮-এর ‘অক্ষত শরীর: রক্তাক্ত জামা’য় পৌঁছনো কম যন্ত্রণার নয়। বিশেষত তাঁর পক্ষে, যাঁর যেমন মমতা মাস পয়লায় ভিড় বাসে মাইনে খোয়ানো বেওকুফ গোষ্ঠবিহারীর জন্য, তেমনই উষ্ণতা ব্যাঙ্কের ঝকঝকে কর্মী উৎপলের জন্য।
পাঠক ভাবতে পারেন, প্রথম পর্বে রইল সেই সব কাহিনি, যারা গল্পহীনতার, না গল্পের, তা নিয়ে লেখকের উভটান প্রথম খণ্ডের পাণ্ডুলিপি তৈরির সময়েও কাটেনি। দ্বিতীয় পর্বে, যেখানে আছে বিখ্যাত ‘অবিরত চেনামুখ’, তার আটটি কাহিনিই বাংলা ভাষায় বাস্তববাদী সাহিত্যের যথেষ্ট সমৃদ্ধ ঐতিহ্যে চিহ্নিত। একান্ত চেনা সব ঘটনা, নিতান্ত সাধারণ সব মানুষ, তুচ্ছ মিথ্যে, তুচ্ছতর সত্যির গ্রন্থনায় দৈনন্দিন হার-জিতের বিচিত্র আখ্যান। শুধু আট জনের সংসারে একমাত্র রোজগেরে চিন্ময়ী বা তার পরের বোন মিনু নয়, এ পর্ব জুড়ে কেবলই অবিরত চেনামুখ; ট্রেন দুর্ঘটনায় হারিয়ে-যাওয়া স্বামীর স্ত্রী (‘মধুময় পৃথিবীর ধূলি’), না-মেটা সাধের মা আর এখনও হয়ে উঠতে চাওয়ার চনমনে সম্ভাবনায় উজ্জ্বল মেয়ে (‘যদি রবীন্দ্রনাথ ফোটে’), ভিড় বাসে কাঠের পা নিয়ে বেপরোয়া যাত্রী (‘কাঠের পায়ে রক্তমাংস’), ফুটপাথের পি সি ভি চটি আর হাওয়াই চপ্পল বিক্রেতা (‘দিনযাপনের গণিত’), নাবালকের জি কে-র খোঁজে মরিয়া দাদু (‘প্রজাপতি চর্চার ইতিবৃত্ত’), গৃহযুদ্ধের দুই অসম প্রতিপক্ষ আর বনের মোষ তাড়ানো দর্শক (‘যুদ্ধকালীন অশনব্যসন’), চাবি হারানো স্ত্রীর স্বামী (‘নিজবাসে অনাবাসী’), সকলেই। ফারাক কেবল সময়ের, ঘটনার, পরিণামের। মিনুর কান্নার সত্যি গল্পান্তরে ছড়িয়ে যায় কখনও হাসিখুশিতে, কখনও নৈঃশব্দ্যে, কখনও আপসে, কখনও প্রত্যাখ্যানে। সাহিত্য যখন, বেশি-কম উতরোনোর বালাই তো থাকেই!
শেষ পর্বের গল্পগুলিতে লেখকের স্বীকারোক্তি যেন প্রায় প্রত্যক্ষই। সাম্প্রতিকের বাস্তবগ্রাহ্য কথকতায় আর বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠছে না সাম্প্রতিকের ধারাভাষ্য; এমনই হালচাল দিন-দুনিয়ার! রূপকথা, পুরাণ, জাতক, প্রাচীন ইতিহাস, সকলের দুয়ারেই ফেরেন লেখক সাম্প্রতিককে বিন্যস্ত করবার তাগিদে। সেই কবে ১৯৭০-এ লেখা ‘কিংবদন্তি’ গল্পের শিরোনামে আনতে হয় ‘গল্প’ শব্দটি। এ পর্বের বারোটির মধ্যে ন’টি গল্পই ১৯৮০-র পরে লেখা। ‘একটি কাল্পনিক গল্প’র পাঠক দেখেন, সাদা-কালোর লড়াইতে শেষ পর্যন্ত সাদা’কেই সব সময় জিতিয়ে দিতে চাওয়া সাহিত্যিক আজ কতখানি সংকটে! ‘...অবাস্তব গল্প’ বা ‘...ভূতের গল্প’-র গল্প-গল্প চেহারার ভিতরে-ভিতরে আসলে গল্প নয়-এর আয়োজন। বিধানচন্দ্র তারকনাথ কি আবার অবিরত চেনামুখের আদল? পার্ট-টু-র ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছে যে-প্রতিভা, তার দৈনন্দিন কতটা জটিল দু’দশক আগেকার মিনুর থেকে? ভূত আর ভূত নয়-এর দোটানায় আসলে তো ‘...ভূতের আসলে গল্প’ গড়পড়তা এক শশীকান্তর, যার সর্বাঙ্গে যেন ছাপ রেখে গেছে এক দশক আগেকার গোষ্ঠবিহারী। মধু পাল কিংবা বনাভাই মিশে আছে পলাশ কুণ্ডুর বিস্তারে। তবু অবাস্তব কিংবা ভৌতিকের আশ্রয় ছাড়া এ জীবনযাপন গাঁথা যায় না। গল্পবিশেষের উত্তীর্ণতার প্রশ্ন যেন গৌণ, জেগে আছে শুধু আশ্চর্য সাদা এক মনের ভাঙন-যন্ত্রণা, আশপাশের ফুটিফাটার অন্তর থেকে জীবনের উপকরণ খোঁজার আন্তরিক প্রয়াস, আর যাকে জীবনের অনেকখানি সময় জুড়ে অবাস্তব ভেবেছেন, তাকেই সহযাত্রী করে বাস্তবের সন্ধানে ফেরা।
জীবনকে এ সাহিত্য কতখানি অর্জন করল, তা নিয়ে সংশয়ের শেষ নেই লেখকের। গল্পসমগ্র-র পাণ্ডুলিপি তৈরি করতে গিয়ে, লেখা গল্প তিনি নতুন করে ভাবতে চান, লিখতে চান। ১৯৬০-৭০-এর বছরগুলির বাস্তববাদ যদি আজ রূপকথায় ঠেকে থাকে, তবে ‘লক্ষ্মীবুড়ি দোলায় চেপেছে’ গল্পটিকে ‘লক্ষ্মীবুড়ি স্বর্গে যাবে’ নামে সাজালে হয়তো রূপকথা কোনও অন্যকথার সংগতি পাবে। ‘অবিরত চেনামুখ’-এর শেষে মিনুর কান্নার বিন্যাসেও বদলে যায় ভাষা কিংবা রূপক ‘...কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল মিনু। পঞ্চবটীর গণ্ডি ডিঙ্গিয়ে একদিন ওকেও পা ফেলতে হবে’-র ‘পঞ্চবটী’র হয়ে গেছে ‘লক্ষ্মণরেখার’। এক দিদির ঘরে ফেরার কাহিনি সে দিন মিশে গিয়েছিল অনেক দিদির ঘরে না-ফেরার আখ্যানে। দিদিরা প্রত্যেকে যেন অভিন্ন অথচ অনুপমা, আবার প্রবল বাস্তব। অবিরত চেনামুখ কথা দু’টি পাঠকের অভ্যাসের অংশ হয়ে গেছে বহুদিন। ‘পঞ্চবটী’ থেকে ‘লক্ষ্মণগণ্ডি’ কি কোনও বাড়তি অর্থ যোগ করে? কোনও পুরনো অর্থ কেড়ে নেয়? মহাকাব্যের সীতা কি লক্ষ্মণগণ্ডির আবর্ত থেকে কম অসহায় পঞ্চবটীর সীমানায়? ২০১১-য় বা ১৯৬৯-এ, পঞ্চবটীর ভিতরে-বাইরে, লক্ষ্মণরেখা পেরিয়ে না-পেরিয়ে চিনু-মিনুরা অসফল অগ্নিপরীক্ষার সম্মানহীন নিত্যতায় সদাই দীর্ণ! তবু এত দিনের চেনা শব্দ তো সত্যির আরও কাছে যেতেই বদলানো! এ-বদল নিয়ে লেখকের কাছে প্রশ্ন জানানোর উপায় নেই পাঠকের। পরবর্তী খণ্ডগুলিতে ‘ইছামতী বহমান’-এর মতো দেশভাগের যন্ত্রণায় দীর্ণ গল্প, কিংবা গত শতকের ছয়-সাতের দশকে প্রতিরোধের অঙ্গীকারে মরিয়া অথচ বিভ্রান্ত যৌবনের মর্মান্তিক অপচয়ের গল্প, সেই অপচয়ে পূর্বপুরুষের দায়ভাগের গল্প ‘নচিকেতা জানিতে চাহিলেন...’ যে এমন কোনও বদলের স্পর্শ পাবে না, তা ভেবে বিষণ্ণও লাগে। তবু তো অমলেন্দু চক্রবর্তীর গল্পরা আসছে, আরও আসবে, নতুন প্রজন্মের পাঠকের নাগালে! এটা খুব জরুরি ছিল। |
|
|
|
|
|