প্রতি পক্ষ
চেনা যায় বিজ্ঞাপনে
ক্লান্ত আমার মুখোশ শুধু ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে, এ রকমই একটি অধুনা-প্রবাদ পংক্তি লিখেছিলেন এই শহরেরই এক কবি। শঙ্খ ঘোষ। তার পরে, দিন গড়িয়েছে আরও। মাত্র গত সপ্তাহেই যাঁর জন্মদিন গেল, সেই জীবনানন্দ দাশের কথা ধার করে বললে, ‘বয়েস বেড়েছে ঢের নরনারীদের’। বিজ্ঞাপনের জাল আরও নিবিড় হয়েছে। সত্যি বললে, গত দু’দশকে বিজ্ঞাপন যে ভাবে প্রবেশ করেছে জনজীবনে, তা নজিরবিহীন।
‘কমার্শিয়াল ব্রেক’ ছাড়া যে সত্যিই কিছু হয়, সেই কথাটাই, পৃথিবীর আরও অনেক মহানগরীর মতো, কলকাতাও ভুলতে বসেছে হয়তো! সুতরাং, এই শহরের এক শিল্পী যে নিজস্ব সৃষ্টির কাজে বিজ্ঞাপনকেই আঁকড়ে ধরবেন, সেই ভাষাই হয়ে উঠবে তাঁর স্ব-ভাষা, আবার সেই ভাষাই, ছবিতে ও অক্ষরে হয়ে উঠবে নতুন এক অন্তর্ঘাতের মাধ্যম, দু’হাজার বারোয় দাঁড়িয়ে তাতে আর বিস্মিত হওয়ার কারণ নেই।
দেকার্ত-এর সুবিদিত বাক্যটি ধার করে এখন বলাই যায়, আমি কিনি, তাই আমি আছি।
এই বাক্যের একটি উল্টো পিঠ আছে। যদি না কিনি, তা হলে আমি নেই। অর্থাৎ, কিনতে পারেন যিনি, শুধু তিনিই থাকতে পারেন। চতুর্দিকে অজস্র পসরা সাজিয়েছে বাহারি ‘মল’! প্রত্যেকেই সুমিষ্ট হাসি দিয়ে বলছে, এতদিন কোথায় ছিলেন?
কোথায় ছিলাম? কোথায় আছি? কোন দিকে চলেছি?
এই উপভোগ-মদির জগতে এই সব প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজে চলে স্টুডিও ২১-এর সাম্প্রতিক প্রদর্শনী, ‘মিথলজিস: দ্য মিনিং অফ দ্য সাইনস’!
এই সব ছবির একটা তাত্ত্বিক প্রেক্ষিত আছে, নিঃসন্দেহে, কিন্তু এই লেখার ক্ষেত্রে তা ততটা প্রাসঙ্গিক নয়। কারণ, নানাবিধ তত্ত্বকে বাদ দিয়েও প্রতি মুহূর্তে প্রতিটি নাগরিকের সঙ্গে নানা ভাবে, নানা মাত্রায় বিজ্ঞাপনের একটা দেওয়া-নেওয়া চলে। সেই দেওয়া-নেওয়া এবং ফিরিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়েই বয়ে চলে নগরজীবন। সেই জীবনের মধ্যে ঝকঝকে পিকচার পোস্টকার্ডের মতো বিছিয়ে থাকে এক-একটি রাজপথ। প্রতিটি রাজপথের দু’ধারে অজস্র হোর্ডিং। সেই সব হোর্ডিংয়ে হাতছানি। অন্য জীবনের হাতছানি। উন্নততর জীবনের হাতছানি।
‘আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ’, এই কথা যেন অন্য অর্থে সত্য হয়ে উঠল এত দিনে।
আমি কি তা-ই যা আমি হতে চাই?
অতঃপর প্রশ্ন, আমি কী হতে চাই? তাতেও খটকা আছে? ‘আমি’ই কি হতে চাই? নাকি, অন্য কেউ, অন্য কিছু প্রবেশ করেছে আমার ভিতরে? সে-ই চাওয়ায়? আমি যদি ‘যন্ত্র’ হই, তা হলে কে ‘যন্ত্রী’? কিন্তু, আমিও কি নিছকই ‘যন্ত্র’? যে-আমি বিজ্ঞাপন বানায়, আর যে-আমি তা দেখে, দেখে নানা জিনিসপত্র কেনে বা পরিষেবা গ্রহণ করার জন্য ছোটে, তাদের মধ্যে সম্পর্কটা কী রকম?
এই সব প্রশ্ন, সাধারণত, মানুষজন এড়িয়েই থাকতে চায়। জেনেশুনে তবু ভুলে থাকা নয়, চিন্তার ভিতরেই বাসা বাঁধে গভীর আলস্য। তাই, ভাবনাগুলো কদাচিৎ মাথার ভিতরে হানা দিলেও ভাল করে তাদের পিছু ধাওয়া করা হয় না। স্টুডিও ২১-এর এই মেধাবী প্রদর্শনী সেই আলসেমির গায়ে একটি বিপুল কশাঘাত!
শিল্পী অনির্বাণ ঘোষ কর্মসূত্রে একটি প্রসিদ্ধ সংবাদমাধ্যমে কর্মরত। প্রতিনিয়ত, পেশার কারণেই, তিনি ‘দৃশ্য’-বস্তু নির্মাণ করেন। সেই সব দৃশ্য গভীর ভাবেই ঘটমান বর্তমানের সঙ্গে বিলগ্ন। সেই আদান-প্রদান থেকেই তিনি পরিপার্শ্বকে তুলে আনতে চেয়েছেন তাঁর কাজে।
যা দেখি, তা-ই নিশ্চয়ই ‘দৃশ্য’। কিন্তু, তারও তো রকমফের আছে। তার ডাকে নানা ভাবে সাড়া দেয় জনতা। সেই বাঞ্ছিত জনতা, পরিভাষায় বললে ‘টার্গেট অডিয়েন্স’-এর গোত্রভেদে বিজ্ঞাপনের ‘দৃশ্য’গুলিও পাল্টে যায়। প্রতিনিয়ত পাল্টাতে থাকে। বহুরূপে সম্মুখে থাকে, অথচ, প্রতি বারই সে যেন নতুন! কী ভাবে?
স্টুডিও ২১-এর এই প্রদর্শনী সেই পদ্ধতির মধ্যে, প্রকরণের মধ্যে আলো ফেলতে চায়। খুঁড়ে দেখতে চায়, বিজ্ঞাপনের ‘কলা’ এবং ‘কৌশল’। এই সূত্রেই একটি শব্দ খুব জরুরি হয়ে ওঠে। ইংরেজি শব্দটি ‘Sign’। বাংলা অনুবাদে হতেই পারে, ‘চিহ্ন’। এক-একটি বিজ্ঞাপন কী ভাবে কিছু প্রচলিত ‘চিহ্ন’ নিয়ে কাজ করে, উপভোক্তার মনের দুয়ারে কড়া নাড়ে, কখনও আবার নতুন ‘চিহ্ন’ নির্মাণ করে, সে সবই আসলে সংস্কৃতি চর্চার অঙ্গ। এই একমুঠো লেখায় তার উল্লেখ ততটা জরুরি নয়, কিন্তু জরুরি এটাই মনে করিয়ে দেওয়া যে এই শহরের নতুন ধারার শিল্পায়ন এখন সনাতন চিত্রপটের বাইরেও অন্য নানা বিষয় খুঁজে দেখছে। তরুণ শিল্পীরা দৈনন্দিনের আরও পাঁচটা বিষয়ের সঙ্গে একটা পারস্পরিক সংলাপ নির্মাণ করতে চাইছেন।
‘‘এই সংলাপটা জরুরি। আর, স্টুডিও ২১-ও সেটাই চায়। ভাবনাকে নানা সাহসী দিগন্তের দিকে নিয়ে যাওয়া, প্রথাগত ছকের বাইরে বেরিয়ে নিজেকে বিপন্ন করা, সেই ধরনের শিল্পকর্মই চায় এই ‘ছবি-ঘর’”, বললেন প্রদর্শনীর তরুণ কিউরেটর মানস আচার্য।
পুনশ্চ: উৎসাহীদের জানিয়ে রাখা যেতে পারে, রবিবার এবং ছুটির দিন বাদে ১৬ মার্চ পর্যন্ত চলবে এই প্রদর্শনী। সময়কাল সকাল এগারোটা থেকে সন্ধে সাতটা।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.