ব্যাগ গুছিয়ে...
বাসায় ফেরা ডানার শব্দ...
ভোর পৌনে ৬টা। মঙ্গলাজোড়ির লাল মাটির পথ বেয়ে যখন চলেছি, তখন শীতের সকালের কুয়াশাটা যেন সেই ঠাকুরমার ঝুলি-র গপ্পোর দৈত্যটার মতো গপ্ করে আমায় গিলে ফেলল। বাঁ দিকের জলাজমিতে যেন মসলিনের সাদা চাদর পাতা। সুয্যিটার হঠাৎ যেন মনে হল তাই তো, অনেক বেলা হয়ে গেল যে! ধড়মড়িয়ে শীতের কাঁথা সরিয়ে বাইরে আসতেই সোনার কাঠির ছোঁয়ায় কুয়াশা দত্যিটা উধাও। ডান পাশের নলঘাসের বনটার গা ঘেঁষে বড় ইগ্রেটটা লম্বা করে পা ফেলল, ছোট মাছটার দিকে নজর রেখে। ধপধপে সাদা পালকে রোদ পিছলোচ্ছে। ফিরোজা নীলরঙা পালকের চাদরে পিঠ ঢেকে সাদা বুকের মাছরাঙাটা কমলারঙা ঠোঁট বাড়িয়ে ইগ্রেটটাকে একমনে দেখছিল আর মাঝে মাঝে ফিক করে হেসে উঠছিল শুকনো ডালটায় বসে। একটু এগোতেই একটা হুপো। ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছোট্ট ছোট্ট ঝোপগুলোর ফাঁকে খুঁজে চলেছে কী যেন! দেখা হতেই সে কী তাকানো! যেন বলছে কী ব্যাপার! এত সকালে চললে কোথায়? স্যান্ডপাইপার আর স্নাইপাররা লম্বা লম্বা ঠোঁটগুলো বাগিয়ে সারাটা সময় জলাজমিতে কী যে খুঁটে খাচ্ছে...আর ফাঁক পেলেই নিজেদের মধ্যে কথা বলতে মত্ত। কে এল-গেল...বয়েই গেল।
গ্লসি আইবিস আর ব্রোঞ্জড্ উইংড্ জাকানা দুটো একছুটে নলঘাসের জঙ্গলে নিজেদের লুকাল, পিছনে রেখে গেল তাদের ডানার রং। হোয়াইট আইবিসটা সেই রং মাখতে নিজের ডানা মেলল। আমিও পৌঁছলাম দু’কিলোমিটার লালমাটির পথ শেষে নজরমিনারের কাছে। এখান থেকেই নলঘাসের জঙ্গল ঠেলে যে-খাঁড়ির শুরু তা মিশেছে চিলিকায়। প্রায় কুড়ি কিলোমিটার এই জল-জঙ্গলের পথে প্রতি মুহূর্তে নিজেকে তৈরি রাখতে হবে চোখ আর মনকে সজাগ রেখে। দেখা হয়ে যেতে পারে এমন কোনও এক পাখির সঙ্গে, যে বসন্তে নয়, এই শীতেই আপনাকে গান শোনাবে। আপনিও বিভোর হয়ে যাবেন সকালের এই জলসায়। আকাশের নীল, তার ছায়া বুকে নিয়ে ক্লোরোফিল সবুজ শ্যাওলাকে সঙ্গী করে ছিপছিপে চিলিকার খাঁড়ির জল, নৌকার দাঁড়ের হাল্কা শব্দ...জলার গন্ধ আর হাওয়া...মনের সব ক’টা দরজা হাট করে খুলে দেবে...আপনি তখন আশাবরীতে ডুব দিয়েছেন।
কোনও কোলাহল নেই, স্নিগ্ধ পরিবেশ, পাখিদের ডানায় জল ভাঙার গান...তাদের গল্প ভিজিয়ে দিচ্ছে আমার মন...আমি ভেসে যাচ্ছি রিপ ভ্যান উইঙ্কলের মতো এক অজানা জীবনের পথে, যে-পথে পৃথিবীর সব সৌন্দর্য যেন লুটোপুটি খাচ্ছে। ঠান্ডা হাওয়া মাঝেমধ্যে চোখের পাতা ছুঁয়ে যাচ্ছে, অনুভূতির উপলব্ধিতে পরিপূর্ণ হচ্ছে আমার প্রাপ্তির ডালা। মধু তখন আমায় চেনাচ্ছে স্যর! বাঁ দিকে দেখুন, উয়হ হ্যায় পার্পল হেরন। নৌকা একটু এগোতেই সে তার বিশাল ডানার আঁচল মেলল জলের বুকে, শব্দ না করে। হাওয়ায় ভেসে গেল যেন। আমি ক্যামেরা না তুলে দু’চোখ ভরে দেখতে থাকলাম সেই উড়ে যাওয়া...জীবনের সব সমস্যা অতিক্রম করে এমন সাবলীল ভাবে যদি ভেসে যেতে পারতাম! মধুর জিভ থেকে না-পাওয়ার একটা মৃদু চুকচুক শব্দ আচ্ছা শট থা স্যর! কী করে বোঝাই তাকে, এ ছবি ক্যামেরায় নয়, আমার মনের ভিতরে ধরে নিয়েছি, যা কখনওই ‘ডিলিট’ করা যাবে না!
নৌকা চলেছে নলঘাসের জঙ্গল চিরে। সূর্য শাসন করছে আকাশকে...খাঁড়ির জলে তার ছায়া...সারাটা জল জুড়ে যেন হিরের কুচি ভাসছে...চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে তার ছটায়। ডান দিকে আকাশ যেখানে জল ছুঁয়েছে, সেখানে মস্ত এক পাখির ঝাঁক নানান জ্যামিতিক নকশা এঁকে চলেছে আকাশের গায়ে। চোখ সরল যেখানে, সেখানে এক জোড়া ব্রাহ্মণী হাঁস ডানা মেলেছে আকাশের বুকে...লার্জ ইগ্রেটের জুড়িটা কেমন লম্বা গলা তুলে দেখছে সেই উড়ে চলা। এক দিকে একটা ছোট্ট চর...সেখানে একটা খঞ্জনা, ছটফটে, তার লেজটা সমানে ওঠাচ্ছে আর নামাচ্ছে। বেশ কয়েকটা সিগাল সাদা নরম শরীরে কমলারঙা পা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এ বার আমরা ঢুকে পড়েছি ‘টিল’দের রাজত্বে। সারাটা সময় কী যে কিচিরমিচির করে গল্প করে চলেছে, ওরাই জানে। তবে বড্ড লাজুক। একটু কাছে যেতে না যেতেই জল ভাঙল তাদের পায়ের ধাক্কায় আর তারা সরে যেতে থাকল দিগন্তে, যতক্ষণ না মিলিয়ে যায়। খুব কাছে নলের বনে একটা পার্পল মুর হেন নিজের ছায়া বুকে নিয়ে জলে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথম রাউন্ড শেষ করে যখন ফিরছি, তখন মন আরও ভাল করে দিল এক ঝাঁক ব্ল্যাকউইংগড্ স্টিল্ট-এর আকাশে ওড়া। ওদের ডানার ফাঁক দিয়ে উঁকি দেওয়া আলো কী অদ্ভুত একটা রঙের মিশেল তৈরি করেছে আকাশের ক্যানভাসে। সে ক্যানভাসে চোখ রাখতে রাখতেই একটা হালকা মোচড় খেয়ে নৌকাটা ঘুরল...ঠোঁটটা বুকের মধ্যে গুঁজে গোলগাল চোখ পাকিয়ে ঝোপের আড়াল থেকে আমার ওপর নজর রাখছে একটা পেইনটেড স্নাইপ। লেন্স-বন্দি করলাম তাকে। নৌকা ঘাটে বাঁধার আগে জলাজমিতে সূর্য হামাগুড়ি দিচ্ছে। সেই আলোছায়াকে বুকে নিয়ে পেইন্টেড স্টর্কটা যখন ডানা দুটোকে ছড়িয়ে দিয়ে আকাশে উঠল তখন তার পা থেকে ঝরতে থাকা জলের কণাগুলো ইমনের অন্তরা বিছিয়ে দিচ্ছে খাঁড়ির জলের বুকে।
তীরে উঠে দেখি একমুখ হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে নন্দকিশোর ভুজাবল, যিনি তাঁর ভালবাসা দিয়ে আগলে রেখেছেন মঙ্গলাজোড়ির পাখিদের আর মানুষদের। তিনিই শিখিয়েছেন এখানকার মানুষদের, পাখি শিকার না-করে তাদের সংরক্ষণ করতে। উষ্ণ দুটো হাতে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে ‘আবার আসবেন কিন্তু। জানি না, এখানে থাকতে এসে আপনি কত কষ্ট পেলেন!’ হাসিমুখে বিদায় জানালাম তাঁকে। যে কথাটা বললাম না এই উষ্ণতাটুকুর জন্য, এখানকার পাখিদের জন্য, মানুষগুলোর জন্য আবারও আসব। লার্জ ইগ্রেটটা সপ্সপ্ শব্দে ডানা মেলে উড়ে চলল কমলারঙা সূর্যটার দিকে, তার ভিতরে সেঁধিয়ে যেতে। বাতাসে তখন বেহাগ বাজছে!

কী ভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে ট্রেনে ওড়িশার বালুগাঁও। সেখান থেকে অটোরিকশা বা
গাড়ি ভাড়া করে প্রায় ৪৮ কিমি রাস্তা উজিয়ে মঙ্গলাজোড়ি।
কী দেখবেন
পাখি আর পাখি। ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টারের কর্মীদের ব্যবস্থাপনায় তাঁদেরই নৌকায় বেরিয়ে পড়ুন।
নৌকা ভাড়া করে চার-পাঁচ ঘণ্টা ঘোরা যায়। একটা নৌকায় ২-৪ জনের বেশি না বসাই ভাল।
কী করবেন না
ওখানকার মানুষজনের বিশ্বাসে আঘাত করবেন না। পাখি দেখার সময় মোবাইল বন্ধ রাখুন।
জোরে কথা বলবেন না। ধূমপান নয়, ডিওডোরেন্ট মাখবেন না, খাঁড়ির জলে প্লাস্টিক ফেলবেন না।
কখন যাবেন
অবশ্যই শীতে। তবে অন্য সময়ে পরিযায়ী পাখি বাদ দিয়ে অন্য পাখিরা থাকে।
কোথায় থাকবেন
মঙ্গলাজোড়ি ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টারে। মাটিতে বিছানা করে শুতে হয়।
খাবার ব্যবস্থা সেন্টারের লোকেরাই করে দেবেন নামমাত্র মূল্যে।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.