ঠিক এক বছর আগে এই সময় তাঁকে নিয়ে ভারতীয় সহ-খেলায়াড়দের আকুতি ছিল অভূতপূর্ব। টিমমেটরা জনে জনে সেই সময় সাংবাদিকদের বলেছেন, “বিশ্বকাপটা জিততে চাই সচিন পাজির জন্য।” বিশ্বকাপ জেতার পরে উচ্ছ্বসিত তরুণরা কাঁধে করে তাঁকে গোটা ওয়াংখেড়ে ঘুরিয়েছিলেন।
মাত্র এক বছরে সেই ছবিটা অত্যাশ্চর্য ভাবে ঘুরে গিয়েছে! এক দিনের দলে সচিন তেন্ডুলকরকে কি আরও চাই? আজ এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়ে সিডনিতে ভারতীয় দলের আস্তানা পার্ক শেরাটন হোটেলে টিমের মধ্যে গোপন ব্যালটের আয়োজন করা গেলে সচিনের বিপক্ষে রায় যাওয়ার স্পষ্ট আশঙ্কা। জাহির-সহ মাত্র দু’তিনটে ভোটই নাকি তাঁর দিকে যাওয়া নিশ্চিত। প্রকাশ্য মান্যতায় কোনও ঘাটতি নেই। টেস্ট টিমে তিনি আরও থেকে গেলে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু জুনিয়রদের ওয়ান ডে সংসারে যে তিনি সমাদৃত নন, সেই ইঙ্গিত স্বয়ং তেন্ডুলকর বারবার পাচ্ছেন।
সরকারি ভাবে কোথাও মুখ খোলেননি। হয়তো খুলবেনও না। হয়তো আজকের অবজ্ঞার কথা জানা যাবে বছর দু’য়েক বাদের আত্মজীবনীতে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তেন্ডুলকর প্রচণ্ড উত্তেজিত। ঘনিষ্ঠমহলে বলেছেন, শততম সেঞ্চুরির কথা ভেবে টিমে থেকে গেলে তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে এক দিনের সিরিজেই ওটা করে নিতেন। তাঁর কাছে সেঞ্চুরির চেয়ে মর্যাদা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। পন্টিংয়ের দেশে এক দিনের সিরিজ খেলার কোনও ইচ্ছেই তাঁর ছিল না। ভেতরে ভেতরে ধরেই নিয়েছিলেন, ওয়ান ডে আর খেলবেন না। কিন্তু টেস্ট সিরিজে এমন অমর্যাদাকর হারের পর তাঁর মনে হতে থাকে, অস্ট্রেলিয়ার মাটি থেকে ভগ্নদশায় ফেরাটা চরম অসম্মানজনক হবে। ফিরবেন বরাবরের মতো অস্ট্রেলিয়াকে প্রচণ্ড লড়াই দিয়ে। সম্ভব হলে গত বারের মতো জিতে। |
শুক্রবার শ্রীলঙ্কা হোবার্টে জিতে যাওয়ার পর জল ঢুকে যাওয়া টিম ইন্ডিয়া নামক জাহাজের সঙ্কট গভীরতর। পয়েন্ট তালিকায় সকলের নীচে। ৬ ম্যাচে ১০ পয়েন্ট তাদের। সিডনিতে রবিবার অস্ট্রেলিয়াকে হারাতে না পারলে মোটামুটি ফেরার প্লেনের টিকিট ‘কনফার্ম’ করে ফেলতে পারে। ক্রিকেটসংস্কারে বিশ্বাসীদের মনে হবে সিডনি ভারতের এককালের পয়া মাঠ। সচিনের জন্য তো চিরকালীন। টেস্টে সব মিলিয়ে যেখানে ৫৫ গড় তাঁর, সিডনিতে ১৫৭। ওয়ান ডে গড় এমনিতে ৪৪.৮৩। অথচ এসসিজি-তে ৬০.২০।
অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের লোকগাথা অনুযায়ী, এসসিজি-তে বড় ক্রিকেট মানে ভিক্টর ট্রাম্পারের আত্মা খেলা দেখতে আসে। আর সেই আত্মার খুব প্রিয় মানুষ হলেন তেন্ডুলকর। সমস্যা হল, এগুলো সবই প্রাচীন সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। মাত্র ছ’সপ্তাহ আগে এই মাঠেই যে ৮০ করে আউট হয়ে যান তিনি, সেটা অবধি টিমমেটরা ভুলতে বসেছেন। ছ’সপ্তাহ এখনকার ক্রিকেট ক্যালেন্ডার সূচিতে ছ’মাস। কারও মনে থাকে না। সবাই ভাবতে থাকে, গত পনেরো দিনে কী হয়েছে? লোকটা কি রান করেছে? আর সেই বিচারে বারবার বিপন্ন হয়ে পড়ছেন তেন্ডুলকর। ওয়ান ডে-তে ৫ ম্যাচে মোট রান ৯০। গড় ১৮। এমনকী অশ্বিন আর জাডেজাও ব্যাটিং তালিকায় তাঁর আগে। নিউজিল্যান্ডে জঘন্য উইকেটে একটা ছোট সফরে ব্যর্থতা বাদ দিলে এমন পাতালপ্রবেশ তেন্ডুলকরের জীবনে কখনও ঘটেনি। গ্রেগ চ্যাপেলের আমলেও তিনি এমন হেনস্থা হননি যা ওয়ান ডে সিরিজে হচ্ছেন।
চলতি সফরে রোটেশন পদ্ধতিতে এক বার বাদ গিয়েছেন। তেইশ বছরের আন্তর্জাতিক কেরিয়ারে যা এই প্রথম। চ্যাপেল যা বলেছিলেন, বলেছিলেন। এ বার তো নিজের টিমমেট সিনিয়র এক ওপেনার দলে তাঁর জায়গা নিয়ে পরোক্ষে সাংবাদিক সম্মেলনে প্রশ্ন তুলেছেন। রবিবারের ম্যাচ সচিন খেলছেন। বসার কথা গৌতম গম্ভীরের (বসবেন হয়তো সহবাগ)। কিন্তু রোটেশন পদ্ধতি ঠিকঠাক অনুসৃত হলে প্রিয় সারফেসে মঙ্গলবার আবার সচিনের বসার কথা। সেক্ষেত্রে হাতে নিশ্চিত ভাবে থাকছে একটাই ম্যাচ।
সিডনিতে ফোন করে জানা গেল ফের একবার জীবন লড়িয়ে রোববারের ম্যাচের জন্য তৈরি হচ্ছেন সচিন। ওয়ান ডে যা তাঁর ৪৫৯-তম আন্তর্জাতিক। এসসিজি তাঁকে অনেক দিয়েছে। ক্রিকেটজীবনের এই অন্তিম বিপন্নতার মুহূর্তে প্রিয় সারফেস সঙ্গে থাকবে? কোনও কোনও মহলের মনে হচ্ছে ভারত যদি ফাইনালে না-ও যেতে পারে নিজে যদি বড় রান পেয়ে যান। অস্ট্রেলিয়া হবে তাঁর ওয়ান ডে ক্রিকেটজীবনের প্রান্তিক স্টেশন। হয়তো এখানেই ঘোষণা করে দেবেন অবসর। শরীর ফিট থাকলে টেস্টে যদিও খেলবেন আরও দু’টো সিরিজ। অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডের সঙ্গে হোম সিরিজ।
হয়তো সে জন্যই সহবাগ বনাম ধোনি বিতর্কে যখন টিম উত্তাল। যখন বোর্ডের নির্দেশে প্রশাসনিক ম্যানেজার বিশ্বরূপ দে সরকারি বৈঠক ডেকে যুযুধান দুই পক্ষকে বলতে বাধ্য হয়েছেন, “যা হয়ে গিয়েছে, হয়ে গিয়েছে। পাস্ট ইজ পাস্ট। এখন বাকি দু’টো ম্যাচ জেতার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।” তখন সচিন নির্বিকার। সহবাগ আর ধোনিকে নিয়ে এই বৈঠক অবশ্যই বোর্ড প্রেসিডেন্ট শ্রীনিবাসনের নির্দেশে। বোর্ড জনমতের এমনই চাপে পড়েছে যে ভারতীয় ক্রিকেটে ৮০ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট রাজীব শুক্ল শুক্রবার মিডিয়াকে আবেদন জানিয়েছেন পজিটিভ লেখালেখি করার। সামনের দিকে তাকানোর। আজ পর্যন্ত কখনও এ জিনিস হয়নি। দ্রুত আবার তাঁকে খণ্ডন করে অস্ট্রেলিয়ায় থাকা ভারতীয় দলের মিডিয়া ম্যানেজার জি এস ওয়ালিয়া বলেছেন, “মিডিয়ার কোনও দোষ নেই। আমি অন্তত মিডিয়াকে দায়ী করি না।” ড্রেসিংরুম থেকে প্রশাসনসর্বত্র যে বিশৃঙ্খলা এটা তার নবতম নমুনা।
পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে, বাকি দু’টো ম্যাচ জিতে ভারত যদি ফাইনালে ওঠে ধোনিরা নিজেরাই হয়তো আশ্চর্য হয়ে যাবেন। ভারতীয় ড্রেসিংরুমের এমনই খণ্ড-বিখণ্ড চেহারা যে একজন বলছিলেন, “ফাটল যা বেরিয়ে পড়েছে তাতে টিম ইন্ডিয়া নয়, মনে হচ্ছে টিম অব ইন্ডিভিজুয়ালস।” ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে বিপর্যয়ের অনেক ইতিহাস আছে। টানা আট টেস্ট ম্যাচ দল আগেও হেরেছে। ১৯৫৮-৫৯-এ। কিন্তু সেই টিমের ওপর কোনও প্রত্যাশা ছিল না। তার কোনও ওজনও না। শুধু ভারত কেন, বিশ্ব ক্রিকেটেও এমন একটা দৃষ্টান্ত নেই যেখানে আইসিসি ক্রমপর্যায়ে পয়লা নম্বর টিম এ ভাবে ধ্বংস হয়ে ০-৮ হেরে গেল। ওয়ান ডে ফর্ম্যাটে এসেও, বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েও সুড়ঙ্গ শেষের কোনও হদিশ নেই। তাই টিমের শিরদাঁড়া দিয়ে গভীরতম স্রোত বইছে। এত সব বিচিত্র সমস্যা রোজ রোজ হাজির হচ্ছে যে গোটা ড্রেসিংরুম কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে নানা দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। যেখানে বরাবরের প্রিয় সচিন পাজির মূল্যায়নও গিয়েছে বদলে!
অতীতে টিম ইন্ডিয়ার প্রচুর বিপন্নতা একা উদ্ধার করেছেন তেন্ডুলকর। চরমতম সঙ্কটের সময় কৃষ্ণের বাঁশির মতো দেশকে রক্ষা করেছে তাঁর ক্রিকেট ব্যাট। কিন্তু এ বারের অস্ট্রেলিয়া এমন আগ্নেয়গিরি নিয়ে হাজির হয়েছে যে কৃষ্ণের বাঁশিও কাজ করছে না। নিল হার্ভির মতো বরাবর সচিনমুগ্ধদের মনে হচ্ছে, না করার টেকনিক্যাল কারণ হল ফুটস্পিড কমে গিয়েছে সচিনের। যা কাজে লাগাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া পেসাররা।
তিনিতেন্ডুলকর এ সব ভাবনায় মাথা ঘামাচ্ছেন না। একমনা হয়ে রয়েছেন। জেনে গিয়েছেন শততম সেঞ্চুরির চেয়ে এই মুহূর্তে অনেক বেশি কাঙ্খিত মর্যাদা উদ্ধারসূচক একটা ইনিংস। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধেই যদি সেটা আসে টিম ইন্ডিয়ার ভাগ্যাকাশেই শুধু নতুন আলো আসবে না। তিনি নিজেও বেরিয়ে আসবেন ফুরফুরে রোদ্দুরে।
ক্রিকেটলিখিয়েরা বরাবর জীবনের সন্ধান পেয়েছেন টেস্ট ম্যাচের মধ্যে। রবিবারের সিডনি ওয়ান ডে দেখতে ট্রাম্পারের আত্মার সঙ্গে খেলার মাঠে জীবনঅনুসন্ধিৎসুদের ভিড়ও অবশ্যম্ভাবী। |