পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক ঘনঘটার মধ্যেই, কিছুটা আড়ালে হয়তো বা, একটি ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পন্ন হইয়াছে। সাড়ে তিন বৎসর পরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দলে ‘ফিরিয়া’ আসিয়াছেন। ২০০৮ সালের অগস্ট মাসে তিনি খেদোক্তি করিয়াছিলেন যে দুর্ভাগ্যবশত তিনি এমন একটি রাজনৈতিক দলের সদস্য, যাহারা বন্ধ ডাকে। অর্থাৎ তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বন্ধের প্রশ্নে নিজেকে দল হইতে পৃথক করিয়া লইয়াছিলেন। দল হিসাবে সি পি আই এম ২০০৮ সালেও বন্ধে বিশ্বাসী ছিল, ২০১২ সালেও সেই বিশ্বাসে চুলমাত্র চিড় ধরে নাই। ২৮ তারিখের শ্রমিক ধর্মঘটটিকে সর্বাত্মক (বাংলা) বন্ধে পরিণত করিবার ঘোষিত ইচ্ছাটিই তাহার প্রমাণ। অর্থাৎ, নীতিগত ভাবেই সি পি আই এম অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আস্থাবান, তাহার সমর্থক। সাড়ে তিন বৎসর পূর্বে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁহার দলের পথ দুইটি এই গণতন্ত্রের মোড়ে আসিয়াই ভিন্ন হইয়া গিয়াছিল। বুদ্ধদেববাবুর পথটি গণতন্ত্রের পথ তো বটেই, তাহা সুশাসনেরও পথ ছিল। সেই পথে তিনি কয় পা হাঁটিতে পারিয়াছিলেন, তাহা ভিন্ন প্রশ্ন কিন্তু তাঁহার পথ নির্বাচনটি অন্তত আশ্বস্ত করিয়াছিল। বোধ হইয়াছিল, আজ না হউক পরশু অন্তত এই পথেই পশ্চিমবঙ্গে শিল্প আসিবে, উন্নয়ন আসিবে, সুস্থিতি আসিবে। কিন্তু, দলের সদ্য-সমাপ্ত রাজ্য সম্মেলনে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রমাণ করিলেন, সেই আশা নেহাতই ভ্রান্ত ছিল। তিনি জানাইলেন, বন্ধের প্রসঙ্গে তিনি যাহা বলিয়াছেন, সবই ভুল সবই তিনি ফিরাইয়া লইতেছেন, এবং আর কখনও এই ভুল তিনি করিবেন না। তিনি দলের পথেই ফিরিয়া গেলেন। অগণতান্ত্রিকতার পথ। দলও তাঁহাকে ফিরাইয়া লইয়াছে। যথা, ‘খসড়া রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্ট’-এ স্পষ্ট বলিয়াছে, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম কোনও ব্যক্তিবিশেষের ভুল নহে, ‘এ দায় বা দায়িত্ব ব্যক্তি বা কমিটি নির্বিশেষে রাজ্য স্তরের’। নেতার আসনে ফের বুদ্ধদেববাবুই উপবিষ্ট। তিনি সি পি আই এম-এরই নেতা। রাজ্যের নহেন।
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী যে দলের কাছে ফিরিয়া গেলেন, সেই দল কি কোথাও বদলাইয়াছে? রাজ্য সম্মেলনে আত্মশুদ্ধির রব উঠিয়াছিল। কমিউনিস্ট পার্টির ‘আত্মশুদ্ধি’ বস্তুত একটি সংকেত-শব্দ, যাহার অর্থ, দলের মধ্যে বিরোধী কণ্ঠস্বরকে ছাঁটিয়া ফেলা। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সম্মেলনের আত্মশুদ্ধির প্রক্রিয়াটি অবশ্য তত দূরও যায় নাই। অনিল বসু, লক্ষ্মণ শেঠ, সুশান্ত ঘোষ এবং অমিতাভ নন্দীর মতো কিছু নেতাকে রাজ্য কমিটি হইতে ছাঁটিয়াই আত্মশুদ্ধির পালা চুকিয়াছে। লক্ষ্মণ শেঠ বা সুশান্ত ঘোষের ন্যায় নেতাদের বাদ দিবার যুক্তি অনস্বীকার্য। কিন্তু তাঁহাদের বাদ দিলেই কি কাজ ফুরায়? দুর্বৃত্তায়নের কারিগর যাঁহারা, তাঁহাদের অনুগামী হইয়া যে দুর্বৃত্তেরা দলে প্রবেশ করিয়াছিল, ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করিয়াছিল, তাহাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা করা হইল? উত্তর নাই। লোকাল, জোনাল অথবা জেলা কমিটির যে দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতারা ‘স্থানীয় স্বশাসনের’ নিজস্ব ব্যবস্থা তৈরি করিয়া লইয়াছিলেন, তাঁহাদের ক্ষেত্রেও দল নীরবই থাকিল। বয়সের ভারে নিজেরাই অবসর গ্রহণ করিতে চাহিতেছেন, এমন নেতাদেরও আপাতত সরানো হইল না। আত্মশুদ্ধির নামে সি পি আই এম যাহা করিল, তাহাকে কর্কট রোগের চিকিৎসায় ওষ্ঠরঞ্জনী ও গন্ধতেলের প্রয়োগ বলা চলিতে পারে। ইহা দলীয় নেতৃত্বের দুর্বলতার পরিচায়ক। পশ্চিমবঙ্গের জন্য ইহা দুঃসংবাদ। এই রাজ্যের রাজনৈতিক মানচিত্রে দলটি আরও কিছু দিন থাকিবে, হয়তো কখনও ক্ষমতাতেও ফিরিবে। এক দিকে গণতান্ত্রিক প্রবণতাকে রুদ্ধ করা, আর অন্য দিকে অভ্যন্তরীণ অসুস্থতার চিকিৎসা করিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হওয়া সি পি আই এম-এর এই দ্বৈত বাস্তব বলিয়া দেয়, পশ্চিমবঙ্গের অন্ধকার, অন্তত অদূর ভবিষ্যতে, কাটিবার নহে। |