‘নোবেল চোর’ সিনেমার রাস্তায় সুমন ঘোষের তৃতীয় পদক্ষেপ। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পদক চুরি নিয়ে আমজনতার ক্ষোভ ও উষ্মার এক অভিনব উদ্গিরণ। বেশ এক উঁচু লক্ষ্য ও আদর্শে তাড়িত হয়ে হালফিলের ঘটনাটাকে গল্পে বেঁধে, চিত্রনাট্যে বিস্তার করে পর্দায় সুন্দর গল্প রচনা করেছেন সুমন। তবে হয়তো একটু ঝটিতিই, কারণ আরও খেলিয়ে, আরও কল্পনা, রংরস, ভাবনা ও থ্রিল যোগ হওয়ার সুযোগ কাজে লাগলে ব্যাপারটা আরও দারুণ জায়গায় পৌঁছতে পারত।
সুমন ‘নোবেল চোর’-এ তথ্যচিত্রের ধাঁচে অনেকটাই বাস্তব এনেছেন, এবং শেষ দিকে থ্রিলার ও সাসপেন্সের চালে ছবির পরিণতি ঘটিয়েছেন। ফাঁকে ফাঁকে গ্রামের মানুষের অভাব, দুর্দশা আর শহুরে লোকের স্বভাব ও দুর্নীতি তুলে ধরেছেন। খুব সরল কাহিনিকথনেই নির্ভর করেছেন, কিন্তু অতিসরলীকৃত কাহিনি এবং বহু বলা, বহু শোনা চালাকচতুর কী সেন্টিমেন্টাল সংলাপের গেরোয় ফেঁসেছেন। ফলে ‘নোবেল চোর’ শেষমেশ একটা আবেগপ্রবণ ছবিই থেকে গেছে। বাংলায় আর পাঁচটা ছবির থেকে অনেকটাই আলাদা যদিও। কিন্তু নিছক আলাদা হওয়াটাই সুমনের থেকে আমাদের সব প্রত্যাশা মেটায় না। |
গরিব চাষি ভানু এক সকালে কুয়োতে কুলকুচি করতে করতে মাটিতে সোনার কী একটা পড়ে থাকতে দেখল। যেই বুঝল সেটা সোনা অমনি শুরু হল ওর জীবনের সেরা সমস্যা। সেটা রাখবে না ফেরত করবে। তখন ধরল গিয়ে গ্রামের সচ্চরিত্র মাস্টারমশাইকে। তিনি আকাশ থেকে পড়লেন যেই দেখলেন ভানুর আকাশ থেকে পড়া সোনাটা আসলে রবি ঠাকুরের জেতা নোবেল পুরস্কারের সোনার মডেল! এই শুরু হল গপ্পো।
মাস্টারমশাই পরামর্শ দিলেন পদকটা সরকারের হাতে পৌঁছে দিতে। কিন্তু সরকারটা কে, তিনি কোথায় থাকেন, তেনারে খায় না মাথায় মাখে তার তো কিসুই জানে না ভানু। তখন গ্রামের মাথারা একজোট হয়ে উপদেশ করতে লাগল ভানুকে। এ যেন ভানু পেল লটারি, কিন্তু জানে না সেটা কী করে ভাঙাতে হয়। শেষে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর হাতে সেটা ন্যস্ত করতে পদক, মাস্টারের দেওয়া রবি ঠাকুরের একখান ফটো, আর কাঁধের এক ঝোলা নিয়ে কলকাতার পথে বেরিয়ে পড়ল ভানু। তার প্রথম কলকাতা অভিযান।
অভিযানই বটে! গরিব চাষির কাছে কলকাতা তো চাঁদের বাড়া। একেক দরজায় একেক কাণ্ড। কত লোক, কত মেজাজ, কত ধান্ধা! ভানুর কলকাতা আবিষ্কারের পর্ব সুমন কাজে লাগিয়েছেন মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত বাঙালির চরিত্র বিশ্লেষণে। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বাঙালির অন্তঃসারশূন্য ভাবাবেগকে দিব্যি ঠাট্টা করেছেন। পুলিশ ও প্রশাসনকে এক হাত নিয়েছেন। এবং শেষে, অবধারিতভাবে, ছড়িয়ে পড়েছেন মেলোড্রামায়। সে সব ব্যাপার পর্দায় দেখুন পাঠক...
ভানুর ভূমিকায় মিঠুন চক্রবর্তী একাই একশো। চোখেমুখে ওঁর অভিনয়ের তুলনা নেই। তবে বীরভূমী চাষির উচ্চারণ অত পরিপাটি না হলেই ভাল হত। একেবারে শেষে, কলকাতার বড়লোকদের সামনে, একটু আধটু গ্রামীণ উচ্চারণ পাওয়া গেল। সব মিলিয়ে যদিও ওঁর কাজ হল, যাকে বলে, স্টেলার পারফরম্যান্স। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মাস্টারমশাই প্রায় নিখুঁত, চলা-বলা-ভাবভঙ্গি সব মিশিয়ে। ভানুর বউ হিসেবে সোমা চক্রবর্তীর উচ্চারণ, কান্না, প্রতিক্রিয়া নিটোল, নিখুঁত। শাশ্বত, সুদীপ্তা, অরিন্দম যথাযথ। দু’টো ক্যামিও রোলে চমৎকার রাজ করেছেন, এবং তাঁদের নিজস্ব অবস্থান ও যুক্তি বুঝিয়েই কাজ করেছেন, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের অ্যান্টিক ডিলার এবং বিশ্বজিত চক্রবর্তীর ‘মাড়বাড়ি বেওয়াসি’। বিশেষ করে নজরে পড়ল হর্ষ ছায়ার কাজ, চমৎকার। বেশ ভাল রূপা। ছবির এক উন্নত বিবেকে।
বরুণ মুখোপাধ্যায়ের চকচকে ফটোগ্রাফি, ছবির সম্পাদনা, এ সব তাদের কর্তব্য পালন করছে। বিক্রম ঘোষের সুরারোপ ও সুরায়োজন ওঁর সুরের ঘরানার থেকে একেবারে ভিন্ন হলেও ওঁর মতো গুণী শিল্পীর কাছ থেকে আমরা আরও নতুন কিছুর আশায় ছিলাম।
রবি ঠাকুরের পদক হারিয়ে যাওয়ার দুঃখ আমাদের যাওয়ার নয়। যদিও সুইডিশ অ্যাকাডেমি সেটির একটি রেপ্লিকা বিশ্বভারতীতে পাঠিয়েছেন। সেই বেদনা নিয়ে সুমন ঘোষের সৎ অনুভূতির ছবিও একটা সান্ত্বনার মতোই হল। ভাল ছবির জন্য হা-হুতাশ করা বাঙালি ছবিটা দেখলে ভালই করবেন, নিজেদের মুখোমুখি হতে পারবেন।
|
নোবেল ধামাচাপা |
২৫ মার্চ, ২০০৪
নোবেল-সহ ৫২টি জিনিস শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবন থেকে চুরি গিয়েছে বলে জানাজানি। |
২৭ মার্চ, ২০০৪
নোবেল চুরির তদন্তভার নিল সি আই ডি। |
২৮ মার্চ, ২০০৪
নোবেল চুরির তদন্তভার সি বি আই-য়ের হাতে দেওয়া হোক, এই আবেদন নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে তিনটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের। |
৩১ মার্চ, ২০০৪
সিবিআই-এর হাতে নোবেল চুরির তদন্তভার। |
৩০ অগস্ট, ২০০৭
বোলপুর এসিজেএম আদালতে সিবিআই জানায়, নোবেল চুরির তদন্তে কোনও অগ্রগতি না হওয়ায় তারা সাময়িকভাবে তদন্ত বন্ধ রাখতে চায়। চিঠি দিয়ে বিষয়টি বিশ্বভারতীকেও জানায় সিবিআই। |
২০০৭-এই ফের সূত্র মিলেছে বলে ওই এসিজেএম আদালতেই পুনর্তদন্তের আবেদন সিবিআই-এর। অথচ তারপর আরও সূত্রের অভাবে আবার নিজেরাই তদন্ত বন্ধ করে দেয় তারা। |
৩ ডিসেম্বর, ২০০৯
বিশ্বভারতীর আইনজীবী এসিজেএম আদালতে আবার তদন্ত শুরু করার আবেদন জানান। |
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১২
তদন্ত বন্ধই। বিশ্বভারতীতে নোবেল-এর রেপ্লিকা। সিনেমা হলে ‘নোবেল চোর’। |
|