এ যেন আক্ষরিক অর্থেই ভাঙা হৃদয় জোড়া লাগানোর চেষ্টা!
হার্ট অ্যাটাকের পরে হৃদপিণ্ডের নষ্ট হয়ে যাওয়া পেশিগুলির মেরামত শুধু নয়, নতুন পেশির জন্ম দেওয়ার চেষ্টা চলছে ওই হার্ট থেকে সংগ্রহ করা স্টেম সেলের মাধ্যমে। চিকিৎসকদের বক্তব্য, এখন অ্যাঞ্জিওপ্ল্যাস্টি বা বাইপাস সার্জারি করে হার্ট অ্যাটাকের পরে বেঁচে থাকা কোষগুলির মৃত্যু ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু যে অংশ হার্ট অ্যাটাকের কারণে মরে গিয়েছে, তাকে বাঁচানোর কোনও ব্যবস্থা করা যায় না। কার্ডিয়াক স্টেম সেল ব্যবহার করে এ বার ওই মৃত অংশকেও বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব হবে। তার ফলে হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসা করে সুস্থ হয়ে ওঠার পরে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক গতিসম্পন্ন জীবনযাপনে কোনও সমস্যা হবে না বলে মনে করা হচ্ছে। ‘ল্যানসেট’ পত্রিকায় সম্প্রতি প্রকাশিত এই গবেষণাপত্রটি নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে এখন জোর জল্পনা চলছে। এই গবেষণা ও তার পরবর্তী ধাপের প্রয়োগগুলি সফল হলে হৃদরোগের চিকিৎসায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ভারত এবং গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় হার্ট অ্যাটাক যে ভাবে মহামারীর আকার নিচ্ছে, তাতে এখানকার চিকিৎসক মহলও অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রয়েছেন গবেষণার পরবর্তী ধাপের দিকে।
লস অ্যাঞ্জেলেস-এর সেডার্স-সিনাই হার্ট ইনস্টিটিউট এবং বাল্টিমোর-এর জন হপকিনস হাসপাতালে যৌথ ভাবে এই গবেষণা চালানো হয়েছিল। প্রথম পর্যায়ের গবেষণায় বেছে নেওয়া হয়েছিল ২৫ জন রোগীকে, যাঁদের গড় বয়স ৫৩ বছর। সকলেরই অল্প কিছু দিন আগে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। এঁদের মধ্যে ১৭ জনের উপরে প্রয়োগ হয়েছিল স্টেম সেল থেরাপি এবং বাকি সাত জনের প্রথাগত পদ্ধতিতেই চিকিৎসা হয়েছিল। এক বছর পরে দেখা যায়, প্রথম ১৭ জনের হার্টের ক্ষতিগ্রস্ত কোষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। সেখানে নতুন কোষের জন্মও হয়েছে। প্রাথমিক ধাপে গবেষণাটি সফল হলেও আরও বড় আকারে গবেষণা যে প্রয়োজন, সে কথা স্বীকার করে নিয়েছেন ওই দুই সংস্থার চিকিৎসক-বিজ্ঞানীরা। তবে তাঁদের দাবি, এখনও পর্যন্ত যা অগ্রগতি তাতে হৃদরোগের চিকিৎসায় নতুন ইতিহাসের সূচনা হতে চলেছে অচিরেই।
স্টেম সেল এমনই কোষ, যা থেকে দেহের যে কোনও অংশের কোষ পুনর্নির্মাণ করা সম্ভব। বিশেষজ্ঞরা জানান, অতীতে অস্থি-মজ্জা থেকে স্টেম সেল সংগ্রহ করে তা হার্টে পুনঃস্থাপিত করার চেষ্টা হয়েছিল। সে ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, নতুন তৈরি কোষগুলি হার্টের কোষের মতো সদা-সক্রিয় থাকতে পারছে না, ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। তখন বিকল্প প্রক্রিয়া ভাবা হয়।
সাম্প্রতিক এই গবেষণায় হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত ১৭ জনের হার্টের সুস্থ অংশ থেকে বায়োপসির মাধ্যমে সামান্য টিস্যু সংগ্রহ করা হয়েছিল। তার পরে ওই টিস্যু গবেষণাগারে কালচার করে তা থেকে একাধিক কোষ তৈরি করা হয়। তার পরে তা ফের রোগীর করোনারি আর্টারিতে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে প্রবেশ করানো হয়। বাকি আট জনের ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাকের যে চিকিৎসা সাধারণ ভাবে প্রচলিত, সেটাই করা হয়েছে। এক বছর নিয়মিত নজর রাখার পরে দেখা যায়, প্রথম ১৭ জনের হার্টে রক্ত চলাচল অনেকটাই স্বাভাবিক এবং মৃত কোষের সংখ্যাও বাকি ৮ জনের তুলনায় অনেকটাই কম।
হৃদরোগ চিকিৎসক অরুণাংশু গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “এটা একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার। এই চিকিৎসা-পদ্ধতি চালু হলে রোগীর জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে, চিকিৎসার খরচ কমবে এবং রোগীর কর্মক্ষমতা বজায় থাকবে। এটা যে কোনও সমাজের অর্থনীতিতেও গভীর প্রভাব ফেলতে চলেছে।” এর ফলে হার্ট ফেইলিওর-এর সংখ্যাও কমবে বলে মনে করছেন হৃদরোগ চিকিৎসক শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। হার্ট ফেইলিওর কাকে বলে? তিনি বলেন, “হার্ট ফেইলিওর মানে হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যাওয়া নয়। ‘ফেইলিওর’ বলতে বোঝায় হৃদযন্ত্রের যে কাজ করার কথা, তার ৫০ শতাংশ বা তারও কম কাজ করা। কার্ডিয়াক স্টেম সেল ব্যবহার করে হার্টের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে আমরা আশা করছি।”
কিন্তু এই নয়া পদ্ধতি কতটা নিরাপদ? চিকিৎসকদের বক্তব্য, এখনও পর্যন্ত যতটা জানা গিয়েছে তাতে ঝুঁকির দিক সে ভাবে সামনে আসেনি। তবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য পরবর্তী ধাপের গবেষণা এবং ক্লিনিকাল ট্রায়ালের দিকে চোখ রাখা জরুরি। হৃদরোগ-বিশেষজ্ঞ অশোক করের বক্তব্য, “গোটা প্রক্রিয়া শেষ হয়ে এই চিকিৎসা পদ্ধতি সাধারণ ভাবে চালু হতে আরও কয়েক বছর সময় লাগবে। কিন্তু এক বার চালু হলে তা হৃদরোগীদের আক্ষরিক অর্থেই নতুন জীবন দিতে পারবে।” |