প্রধান মুখ্য বনপাল বনাম বনমন্ত্রী, বিতর্ক মিটছে না।
বেআইনি করাত কল বন্ধ করার নির্দেশ দিয়ে বনমন্ত্রী হিতেন বর্মনের বিরাগভাজন হয়েছিলেন পূর্বতন প্রধান মুখ্য বনপাল (পিসিসিএফ) অতনু রাহা। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সদ্য অতনুবাবুর স্থলাভিষিক্ত হয়ে এমএ সুলতানও উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গে ছড়িয়ে থাকা বেআইনি করাত কলগুলির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেই হিতেনবাবুর ‘কোপে’ পড়েছেন।
বুধবার তাঁকে ডেকে অভিযান বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন বনমন্ত্রী। বন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রধান মুখ্য বনপাল অবশ্য হিতেনবাবুকে জানিয়ে দেন, ‘অভিযান বন্ধ রাখা সম্ভব নয়’। দফতরের শীর্ষ আধিকারিকের পাল্টা মনোভাব দেখে বৃহস্পতিবার উত্তরবঙ্গে স্থানীয় বনপালদের বৈঠকে ডেকে অভিযান বন্ধ রাখার ফের নির্দেশ দিয়েছেন বনমন্ত্রী। বৈঠকে হিতেনবাবু জানান, ‘সেন্ট্রাল এমপাওয়ারড কমিটি’র অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে করাত কলগুলি। তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো যাবে না।
মন্ত্রীর চাপে অবশ্য মাথা না নোয়াতে অনড় সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত পিসিসিএফ। ক্ষুব্ধ সুলতান ঘনিষ্ঠ মহলে জানান, এ ব্যাপারে তিনি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বারস্থ হবেন। তিনি বলেন, “কারও চাপে নির্দেশ তুলে নেওয়ার প্রশ্ন নেই। লাইসেন্স-বিহীন করাত কল বন্ধ করার অভিযান যাতে থেমে না-যায় বিভাগীয় আধিকারিকদের সেই নির্দেশ দিয়েছি।” তাঁর নির্দেশে ইতিমধ্যেই বাঁকুড়ায় ৮৭টি লাইসেন্স বিহীন করাত কল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। |
এক দিকে, করাত কল বন্ধের অভিযান শুরু না করলে ‘বিভাগীয় তদন্তের’ হুঁশিয়ারি জারি করা শীর্ষ আধিকারিকের চিঠি, অন্য দিকে অভিযানের পথে পা বাড়ালে মন্ত্রীর কোপে পড়ার হুঙ্কারবনকর্তাদের এখন ‘শাঁখের করাত’ অবস্থা। এক পদস্থ কর্তার কথায়, “আমাদের অবস্থা এখন, জলে কুমির ডাঙায় বাঘ!”
কিন্তু বেআইনি করাত কল বন্ধ করায় আপত্তি কেন?
হিতেনবাবু বলেন, “সেন্ট্রাল এমপাওয়ারড কমিটির তালিকাভুক্ত হয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে রাজ্যের ১৬২১টি করাত কল। কিছু দিনের মধ্যেই তারা লাইসেন্স পাবে। আমি সেগুলি বন্ধ না করার জন্য পিসিসিএফ’কে নির্দেশ দিয়েছিলাম। আমাকে বা দফতরের প্রধান সচিবকে না জানিয়ে পিসিসিএফ সেগুলি বন্ধ করার নির্দেশ দেন কী করে!”
প্রশ্ন, ওই কমিটির তালিকাভুক্ত হয়েও করাত কলগুলি অনুমোদন পেল না কেন। বন দফতরের খবর, ২০০৫-এ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে রাজ্যের কাঠ-শিল্প বিষয়ক আইনের সংশোধন হয়েছিল। নির্দেশ অনুযায়ী করাত কলের পাশাপাশি প্লাইবোর্ড তৈরির কারখানাগুলিও ওই তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। করাত কলগুলির আদৌ অনুমোদন মিলবে কি না, তা খতিয়ে দেখার দায় বর্তেছিল এমপাওয়ারড কমিটির উপরে। কিন্তু গত ৭ বছরে তালিকাভূক্ত কারখানাগুলির হালচাল খতিয়ে দেখে তাদের অনুমোদন দেওয়া হবে কি না, তা জানায়নি কমিটি। সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশিত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত প্রধান মুখ্য বনপাল রাকেশ সিনহাও মন্তব্য করতে চাননি। হিতেনবাবু বলেন, “করাত কল বা প্লাইউড তৈরির কারখানাগুলি বৈধ না অবৈধ সে প্রশ্ন অমীমাংসিত। কমিটির সিদ্ধান্ত না জেনে করাত কলগুলি অবৈধ ঘোষণা করা হচ্ছে কোন আইনে?”
পিসিসিএফ পদে দায়িত্ব নেওয়ার পরেই, ১২ ফেব্রুয়ারি লাইসেন্স বিহীন করাত কলগুলি পনেরো দিনের মধ্যে বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন পিসিসিএফ। শীর্ষকর্তার নির্দেশ পেয়ে অভিযানে নেমে ছিলেন বনকর্তারা। এই সময়ে ফালাকাটার বিধায়ক তথা বন উন্নয়ন নিগমের ভাইস চেয়ারম্যান অনিল অধিকারীর বাড়ি লাগোয়া তাঁরই এক আত্মীয়ের করাত কলও বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিষয়টি মন্ত্রীর কানে পৌঁছতেই নড়েচড়ে বসেন হিতেনবাবু। বনকর্তা ও বনমন্ত্রীর দ্বন্দ্বের সূত্রপাত সেখান থেকেই। ‘বিবাদ’ মিটতে শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপই অবশ্যম্ভাবী হয় কিনা, দেখার সেটাই। |