|
|
|
|
আবিষ্কারের আবিষ্কর্তা টমাস আলভা এডিসন |
কানে শুনতে পেতেন না। স্কুল পাশ করেননি। নিজের ইচ্ছের জোগান দিতেন কাগজ বিক্রি করে।
একেবারে অপদার্থ। তাঁরই আবিষ্কারের সংখ্যা: ২৩৩০। ১১ তারিখ ছিল তাঁর জন্মদিন। পথিক গুহ |
ইসকুলের পড়াশোনা যাঁর সারা জীবনে মাত্র তিন মাসের, তিনিই ২,৩৩০টি নতুন জিনিসের আবিষ্কর্তা। এক কানে যিনি পুরো বধির, আর অন্য কানে শ্রবণক্ষমতা মাত্র কুড়ি শতাংশ, তিনিই টেলিফোনের মতো অনেক যন্ত্রের উন্নতির রূপকার। বাউন্ডুলে দেশভ্রমণের শেষে যিনি কপর্দকশূন্য, পরিবার দেনায় জর্জরিত, তিনিই পরে সবচেয়ে ধনী বিজ্ঞানী। ভাবা যায়!
তাঁর নাম টমাস আলভা এডিসন। সেল্ফ-স্টাইল্ড, কিংবা সেল্ফ-মেড শব্দগুলোর যিনি সব সেরা উদাহরণ। বিজ্ঞান গবেষণায় কতটা দিন বদলেছে, একক উদ্যোগে সাফল্য আর সম্ভব কি না, এ সব প্রশ্ন এখন সমাজতাত্ত্বিকদের বিশেষ আলোচনার বিষয়। অতীত থেকে বর্তমান কতখানি আলাদা, তার বিচারে নমুনা হিসেবে আমরা ওই মানুষটির জীবন একটু ঘাঁটতে পারি। ভাবতে পারি, এ যুগে এক জন এডিসন-এর আবির্ভাব কি সম্ভব? নাহ্, ঊনবিংশ শতাব্দীতে যা ঘটেছিল, তেমনটা হয়তো আর সম্ভব নয় এই একবিংশ শতাব্দীতে। এক জন টিম বার্নস লি-র কৃতিত্বে শুরু হতে পারে ডব্লিউ ডব্লিউ ডব্লিউ-এর দুনিয়া, দু’এক জন মার্ক জাকারবার্গ পথ মসৃণ করতে পারেন সামাজিক যোগাযোগের, কিন্তু প্রযুক্তি আজ এত শাখায় এত বেশি দূর এগিয়েছে যে, কারও একার পক্ষে অনেক বিষয়ে অনেকগুলো আবিষ্কার আর কখনও সম্ভব হবে না। যেমনটা সম্ভব হয়েছিল এডিসন-এর জীবনে।
জন্ম ১৯৪৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। আমেরিকার ওহায়ো প্রদেশের মিলান শহরে। পূর্বপুরুষরা হল্যান্ড থেকে আমেরিকায় এসেছিলেন ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দে। বংশপরম্পরায় সবাই সুঠামদেহী। এবং দীর্ঘায়ু। প্রপিতামহ টমাস এডিসন বেঁচেছিলেন ১০৪ বছর। পিতামহ জন এডিসন ১০২ বছর। বাবা স্যামুয়েল এডিসন ৯২ বছর। অবশ্য মা, বিয়ের আগে যিনি ন্যান্সি এলিয়ট তিনি বেঁচেছিলেন মাত্র ৬১ বছর। টমাস আলভা এডিসন-এর জীবনে এই মহিলার ভূমিকা কিন্তু বিরাট।
শিশু এডিসন সমবয়সিদের তুলনায় চেহারায় বড়। কপাল তার একটু বেশি চওড়া। ফলে কিঞ্চিৎ বিসদৃশ। এই শিশু বড়দের বড্ড জ্বালায়। হাজারও প্রশ্ন করে। এটা কী? ওটা কেন হয়? জবাব দিতে দিতে বয়স্করা ক্লান্ত। তাঁদের জ্ঞানের ভাঁড়ার উজাড় হয়ে গেলেও নিস্তার নেই। কোনও প্রশ্নের উত্তরে ‘জানি না’ শুনলে এডিসন-এর পাল্টা প্রশ্ন ‘কেন?’
এ শিশুর পক্ষে স্কুলের ক্লাস কেমন হবে, তা অনুমান করা যায়। ভর্তির কয়েক দিনের মধ্যে শিক্ষকদের প্রবল ধমকানি। এবং অভিভাবকদের কাছে অভিযোগ। মানসিক সমস্যা আছে ছাত্রের। সমস্যা বুঝলেন কেবল মা। কারণ, তিনি নিজে শিক্ষিকা। তিন মাসের মাথায় স্কুলের খাতা থেকে নাম কাটিয়ে ছেলেকে আনলেন বাড়িতে। শেষ হল এডিসন-এর বিদ্যালয়-জীবন। এর পর স্কুল বাড়িতে। আর লাইব্রেরিতে। একের পর এক কিনে আনা বইতে। কী সব বই! ‘রাইজ অ্যান্ড ফল অব দ্য রোমান এম্পায়ার’, ‘সিয়ারস হিস্ট্রি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’, ‘অ্যানাটমি অব মেলানকলি’, ‘দি ওয়ার্ল্ড ডিকশনারি অব সায়েন্স’। মোটেই শিশুপাঠ্য নয়, কিন্তু তাতে কী! এডিসন যে ক্ষুধার্ত। অবশ্য সঙ্গে আছে ইনসেনটিভ। একটা বই পড়ে শেষ করলেই দশ সেন্ট প্রাইজ।
ন্যান্সি কী চেয়েছিলেন, কে জানে! ছেলে কিন্তু ধীরে ধীরে প্রেমে পড়ল কেমিস্ট্রি আর ফিজিক্স-এর। আলকাতরা জিনিসটা কী বস্তু? বিজলি বা আসলে কী? এ সব নিয়ে মাথা ঘামাতে বসে এডিসন-এর প্রিয় বিষয় হয়ে দাঁড়াল বিজ্ঞান। আর তার হিরো এক জন। আইজাক নিউটন। পড়তে হবে তাঁর অমর রচনা ‘ফিলোজফিয়া নাচুরালিস প্রিন্খিপিয়া মাথমেটিকা’। পড়তে বসে স্বপ্নভঙ্গ। কঠিন, প্রায় দুর্বোধ্য রচনা। গভীর গণিতজ্ঞান বিনে যার রসাস্বাদন অসম্ভব। হায়, শুধু অধরাই রয়ে গেলেন না হিরো, তিনি রেখে গেলেন এক ক্ষত। জটিল গণিতে বীতরাগ। কিশোর এডিসন এর পর নিজের পথ ঠিক করলেন। বিজ্ঞানের পাঠ এগোবে একের পর এক পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে। বাড়ির মধ্যে ভয়ে জড়সড় মা-বাবার সামনে গড়ে উঠল ল্যাবরেটরি।
খরচ? জোগান দিতে বারো বছর বয়সি এডিসন প্রস্তুত। শুরু হল রেলগাড়িতে হকারি। কাগজ বিক্রি। ক্রমশ কনডাক্টর-এর নেকনেজরে। এবং তার প্রশ্রয়ে মাল বহনের কামরার মধ্যে নিজের জন্য কিছুটা জায়গা। সেখানে একটা ছাপার মেশিন। ট্রেন চলাকালীন খবর জোগাড় করে তা ছাপানো। হকার এ বার কাগজের মালিক। তত দিনে মাল-কামরায় উঠে এসেছে আরও একটা জিনিস। বাড়ির ল্যাবরেটরি। কী আর করা যাবে, ট্রেনেই যে কাটে দিনের আঠারো ঘণ্টা। এক্সপেরিমেন্ট এ বার থেকে চলমান রেলগাড়িতে।
এবং অ্যাক্সিডেন্ট। রেলগাড়িতে হঠাৎ ঝাঁকুনিতে রাসায়নিক ছিটকে পড়ে আগুন। বিরাট ক্ষয়ক্ষতি থেকে বহু চেষ্টায় কোনও ক্রমে রক্ষা। কনডাক্টর অগ্নিশর্মা। এডিসন-এর গালে সজোরে ঘুষি। কানে বড়সড় ক্ষতি। শ্রবণ-ক্ষমতা প্রায় নষ্ট।
এই ঘটনার কিছু পরে আকস্মিক ভাবে এডিসনের জীবনে নতুন মোড়। এক স্টেশন মাস্টারের দাক্ষিণ্যে। তার বাচ্চা ছেলে না-বুঝে চলে গিয়েছিল লাইনের খুব কাছে। পিছনে আসছিল ট্রেন। চাপা পড়ত শিশু। দেখতে পেয়ে ঝাঁপালেন যুবক এডিসন। বাঁচল শিশু। প্রচণ্ড খুশি তার বাবা। তিনি মঞ্জুর করলেন এডিসনের আর্জি। কী? তত দিনে স্টেশনে স্টেশনে বসেছে সে যুগের আশ্চর্য যন্ত্র। টেলিগ্রাফ। টরে-টক্কা। এডিসনের খুব সাধ যন্ত্রটা চালানোর। সুযোগ করে দিলেন উপকৃত স্টেশন মাস্টার। বিষয়টায় দ্রুত দক্ষ হয়ে উঠলেন এডিসন। এ যেন আজকের যুগে কমপিউটার বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠার হয়ে ওঠার শামিল। মাথা খাটিয়ে টেলিগ্রাফ কৌশলের অনেক উন্নতি ঘটালেন এডিসন। বাড়ল চাকরির বাজারে তাঁর চাহিদা। এক শহর থেকে অন্য শহরে নতুন টেলিগ্রাফারের চাকরি নিয়ে ঘুরে বেড়ালেন তিনি। ডেট্রয়েট, বস্টন, নিউ ইয়র্ক।
অনেক দিন পর বাড়ি ফিরে এডিসন বিষাদগ্রস্ত। বাবা বেকার। মা মানসিক অবসাদের রুগি। পরিবারে বড় অনটন। এডিসন মনস্থির করলেন। বাউন্ডুুলে জীবন আর নয়। কাজে লাগাতে হবে নিজের প্রতিভাকে। চাই আরও, আরও প্রযুক্তিজ্ঞান। চাই অর্থ। গড়ে তুলতে হবে গবেষণাগার।
যে খোঁজে, সে পায় সন্ধান। আবার আচমকা সুযোগ। তখন চাকরি করছেন ওয়াল স্ট্রিটে। স্টক এক্সচেঞ্জ-এ টেলিগ্রাফ অপারেটর। সোনার দাম কী ভাবে ওঠানামা করছে, তার খবর দেওয়ানেওয়া। এক দিন হঠাৎ বিকল টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা। শেয়ার বাজারে লঙ্কাকাণ্ড। অবস্থা সামাল দিতে ইঞ্জিনিয়াররা ব্যর্থ। অবশেষে পরিত্রাতা এডিসন। তিনি রাতারাতি বিখ্যাত। নিজে বানালেন উন্নত টেলিগ্রাফ যন্ত্র। পেটেন্ট বিক্রি করলেন নামী কোম্পানিতে। ৩০,০০০ ডলারে। এক সঙ্গে এত আনন্দে উত্তেজনায় রাতে ঘুম এল না এডিসনের।
অফিসে চাকরি, বাড়িতে গবেষণা। ঝিমুনি এলে দেখেন স্বপ্ন। কেমন? চুম্বক, স্প্রিং, গিয়ার, আর্মেচার, ব্যাটারি কিংবা রিয়োস্ট্যাট নাচছে চার দিকে। আসলে ও সব সরঞ্জাম নানা মহিমায় হাজির থাকত তাঁর চিন্তায়। সব সময় ভাবতেন, কোন উপায়ে বাড়ানো যায় ওগুলোর দক্ষতা। আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল তত দিনে আবিষ্কার করেছেন টেলিফোন। কিন্তু, তা তখনও কৌতূহলের যন্ত্র। এডিসনের হাতে পড়ে যন্ত্রটা উন্নত হল অনেক। ব্যবহার বাড়ল হুহু করে।
একই গল্প বিজলি বাতির বেলাতেও। বিদ্যুৎ খরচ করে আলো জ্বালানো। তো তার ফলে যে বাতি তৈরি হয়েছে, তা বিশাল চোখধাঁধানো। তার আলো যেন লাইটহাউসের দীপ্তি। এডিসনের মাথায় এল চিন্তা। এমন বাতি কি বানানো যায় না, যা কাজে লাগবে গৃহস্থের ঘরে? মানে, যার দীপ্তি হবে না চোখ-ধাঁধানো, তবে বাড়িঘর কিংবা পথঘাট হবে আলোকিত। তড়িৎবিজ্ঞানের পাঠ থেকে মুশকিল আসান করলেন এডিসন। কাজে লাগালেন তারের রোধ বা বিদ্যুৎ পরিবহণে বাধা দানের ক্ষমতা। ওই ক্ষমতার বলে বিদ্যুৎ পাঠালে তার হয় গরম। ওই তাপ থেকে মিলতে পারে আলো। ব্যস, তৈরি হল ফিলামেন্ট। ঘরে ঘরে জ্বললো বাতি। শুধু বাল্ব নয়, ঘরে ঘরে বিজলি পৌঁছে দেওয়ার জন্য পাওয়ার স্টেশন বা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র শহরে শহরে কী ভাবে বানানো যায়, তারও পথ দেখালেন এডিসন। আমেরিকায় ন্যাশনাল আকাদেমি অব সায়েন্সেস-এর হিসেব অনুযায়ী, ১৮৬৮ থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ, ২১ বছর থেকে ৮১ বছর বয়সের মধ্যে এডিসন আমেরিকায় পেটেন্ট নিয়েছিলেন ১০৯১টি আবিষ্কারের। আর বিদেশে তাঁর পেটেন্টের সংখ্যা ছিল ১২৩৯টি।
এত আবিষ্কার! হ্যাঁ, বিশাল বড় গবেষণাগার ছিল এডিসনের। পৃথিবীর প্রথম আর অ্যান্ড ডি ল্যাব-এর প্রতিষ্ঠাতা তিনি। সেখানে কাটাতেন দিনের ১৬-১৮ ঘণ্টা। এ প্রসঙ্গে বলতে হয় তাঁর স্ত্রীর কথা। মেরি এডিসন রাতে ঘুমোতেন বালিশের নীচে পিস্তল রেখে। এক কাণ্ডের পর থেকে। ল্যাব থেকে এডিসন বাড়ি ফিরেছিলেন শেষ রাতে। মেরি তখন ঘুমিয়ে। বাড়ির দরজা বন্ধ। কী করা? দেওয়াল টপকে এডিসন ছাদে। বেডরুমে ঢুকলেন জানলা ভেঙে। ঘুম ভেঙে মেরির চিৎকার। ডাকাত পড়েছে বাড়িতে! সেই ত্রাস সঙ্গী ছিল আজীবন। যদি কোনও দিন সত্যিই আসে ডাকাত! সাবধান থাকা ভাল। মাথার পাশে থাক পিস্তল।
শ্রবণশক্তি প্রায় নেই বেচারির। ভেবে কষ্ট পান মেরি ও বন্ধুরা। পরামর্শ দিলেন ওঁরা। কানের অপারেশনের। এডিসন অরাজি। বললেন, প্রায়-বধিরতা তাঁর জীবনে নাকি আশীর্বাদ। কী রকম? হ্যাঁ, কানে প্রায় শোনেন না বলে চার পাশের শব্দে চিন্তার ব্যাঘাত ঘটে না। গবেষণার ভাবনায় মনঃসংযোগ করতে পারেন অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি। এই তো ভাল।
তবে, একটা খেদ ছিল মনে। ওই বধিরতার কারণে। মেরিকে বলতেন দুঃখের কথা। পাখির ডাক শুনতে পান না যে! শখ করে বাড়িতে বানিয়েছিলেন চিড়িয়াখানা। পাখি ছিল হাজারেরও বেশি। ৮৪ বছর বয়সে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সময় পেলে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতেন পাখিদের দিকে। যদি কানে পৌঁছয় ওদের গানের একটুখানি রেশ।
|
অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী |
|
|
|
|
|