প্রায় সাড়ে চার দশক ধরে কীর্তন গাইছেন রাজ্যের নানা অঞ্চলে। বয়স শরীরকে ঘিরে ধরলেও এখনও কীর্তনে ক্লান্তিহীন নবদ্বীপের প্রাচীন মায়াপুরের মালোপাড়ার সরস্বতী দাস। নবদ্বীপের পুরনো বৈষ্ণবদের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধেয়া। দু’বছর আগে নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদ প্রবীণ এই কীর্তনীয়াকে ‘কীর্তন লীলা সারিকা’ সম্মান জানিয়েছে।
সরস্বতীদেবীর আদি দেশ ছিল বাংলাদেশের কুষ্ঠিয়ার ঝিনাইদহের হরিনারায়ণপুর গ্রামে। ১৯৫০ সালে গোটা পরিবার চলে আসে নবদ্বীপে। তখন বয়স মাত্র এক বছর। “দেশ ভাগের পরে, নবদ্বীপে চলে আসার স্মৃতি বিশেষ কিছু মনে নেই। ঠাকুরদা, জটাধারী দাস মহাপ্রভুর স্মৃতির টানে দেশ ভাগের অনেক আগেই চলে আসেন। কীর্তনই ছিল তাঁর বাঁচার একমাত্র অবলম্বন। বসত পেতেছিলেন নবদ্বীপের বিখ্যাত সাধক পাতাল সাধুর আশ্রম সংলগ্নে।”
|
নিজস্ব চিত্র। |
জানালেন সরস্বতীদেবী। একটু থেমে যোগ করেন, “লেখাপড়া বিশেষ হয়নি। পাতাল সাধুর আশ্রমে প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করে, তখনকার ঈশানী স্মৃতি মন্দিরে মাত্র আট ক্লাস শেষ করেছি। তিন বছরে মা চলে গেলেন। পনেরো বছর বয়সে বাবা চলে গেলেন। অনাথ মেয়ের জীবনে চলল অনেক ঝড়। মহাপ্রভুর (চৈতন্যদেব) আর গোপালের (শ্রীকৃষ্ণ) আশীর্বাদে কীর্তন নিয়েই কেটে গেল এতগুলো বছর। জীবনের সঙ্গে যোগ হয়েছে সুর, জপ, তপ, ধ্যান, নিরামিষ আহার, মঙ্গলারতি ও গঙ্গাস্নান।”
পিতা, পিতামহের কীর্তনের সুর এবং পাতাল সাধুর আশ্রমের কীর্তনের পরিবেশই সরস্বতীকে কীর্তনীয়া হিসেবে লালন-পালন করেছে। সেই নিষ্ঠা ও পরিশ্রম সরস্বতীকে দিয়েছে খ্যাতি, করেছে অভাব মুক্ত। কীর্তনে আকৃষ্ট তরুণ-তরুণীদের নিয়ে তৈরি করেছেন কীর্তন-দল ‘শ্রীশ্রীরাইকানু জীউ’। একটু বেশি বয়সে, কৈশোরের শুরুতে নবদ্বীপে বিখ্যাত কীর্তনীয়া হরিদাস কর মহাশয়ের কাছে নাড়া বাঁধা। সে সব স্মৃতি। তবুও সেই সুরেরই বিস্তার চলেছে কীর্তনেপ্রেম, বিরহ ও মিলনে।
নবদ্বীপের গুণীজনেরা বলেন, সরস্বতীর কণ্ঠে মা সরস্বতী, ভাবে শ্রীচৈতন্যের ভক্তিভাব। প্রিয় শিষ্যাকে ‘কীর্তন সরস্বতী’ উপাধি দিয়েছেন গুরু। ঝুলি ভরেছে ‘কীর্তন রসভারতী’, ‘গীতসুধা’ ইত্যাদি নানা উপাধিতে। কেঁদুলির জয়দেবের মেলায় শুরুর অনুষ্ঠানে বহু বছর ধরেই চলছে সরস্বতীর কীর্তন গান। পেয়েছেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কীর্তন সম্রাজ্ঞী’ সম্মান। রেডিও এবং দূরদর্শনেও সরস্বতীদেবীর কীর্তনের অবাধ বিচরণ।
এক সময়ে কলকাতা দূরদর্শনে কীর্তন সম্প্রচার হত না। কারণ কীর্তনের ‘সুরলিপি ও শ্রীখোলের ‘তাললিপি’ না থাকা। বহু মেহনত করে কীর্তনের সুরলিপি তৈরি করেন হরিপদ কর। শ্রীখোলের তাললিপি করে দেন শ্রীখোল বাদক পূর্ণচন্দ্র পাল। এর পর সরস্বতীর কীর্তন পরিবেশিত হয় টিভিতে।
শুধু কীর্তন গাওয়াই নন, কীর্তন নিয়ে যাঁরা পড়াশোনা, গবেষণা করছেন তাঁদের কাছে শিক্ষক হিসাবে সরস্বতীদেবীর যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। জীবনের দীর্ঘপথে কীর্তনে নানা পালা গেয়েছেন। তবে শিল্পীর প্রিয় ‘পূর্বরাগ’ এবং ‘গোষ্ঠপালা’। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কীর্তনের প্রতি মানুষের আগ্রহের খামতি বড় কষ্ট দেয় শিল্পীকে। তাই খেদ ঝরে পড়ে কীর্তনীয়ার কণ্ঠে, “কীর্তনে নব প্রজন্মের আনাগোনা কম। শিখলে কিন্তু জীবিকা-সম্মান সবই আসে মহাপ্রভুর কৃপায়। তবে চাই নিরলস ভক্তি ও পূজার বোধ।” করজোড় কপালে ঠেকালেন সরস্বতী। |