|
|
|
|
ধর্মঘট-বিরোধিতার ‘ভুল’ কবুল করলেন বুদ্ধদেব, তোপ টাটাকেও |
প্রসূন আচার্য ও সন্দীপন চক্রবর্তী • কলকাতা |
ভাঙলেন। তবু মচকালেন না! দলের রাজ্য সম্মেলনে সমালোচনার ঝড়ের মুখে প্রাণপণে শিল্পায়নের নীতিকে আগলানোর চেষ্টা করলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
আর সেই প্রক্রিয়ায় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর মুখে ‘চাঞ্চল্যকর’ সব স্বীকারোক্তি শুনলেন প্রতিনিধি-সহ সম্মেলনে উপস্থিত প্রায় ৮০০ মানুষ। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটের উপস্থিতিতেই শুক্রবার দলের অন্দরে বুদ্ধবাবুর অকপট স্বীকারোক্তি, ধর্মঘট প্রসঙ্গে তিনি যা বলেছিলেন, তা ‘ভুল’ হয়েছিল। সিঙ্গুর-প্রশ্নে সহসা ‘মত পরিবর্তনে’র জন্য এক হাত নিলেন রতন টাটাকে। বামফ্রন্ট সরকারের শেষ তিন বছর রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ স্তর তাঁর সঙ্গে সহযোগিতা করেনি বলে অভিযোগ করলেন।
তবে এত কিছুর মধ্যেও শিল্পায়নের মূল নীতিতে তিনি অনড়। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামে নানা স্তরে কিছু ভুল হয়েছিল মেনেও বুদ্ধবাবু বললেন, যার জন্য কারখানা, সে না-বুঝলে ‘খুব বিপদ’! রাজ্য রাজনীতিতে উথালপাতাল অভিঘাতের পরে এটাই তাঁর ‘উপলব্ধি’ আক্ষেপের সুরে বলেছেন বুদ্ধবাবু। বক্তৃতা যখন শেষ করেছেন, ৮০০ মানুষ উঠে দাঁড়িয়ে করতালি দিচ্ছেন! সিপিএমের মতো দলে সম্মেলন-পর্বে যে দৃশ্য অভিনব! আর দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রতি বুদ্ধবাবুর পাল্টা অনুরোধ, এই সম্মেলন থেকেই যাবতীয় ‘বিতর্কের অবসান’ হোক।
রাজ্য সম্মেলনে তিন দিন ধরে তাঁর নেতৃত্বাধীন বিগত সরকারের তুমুল সমালোচনা হয়েছে। যার অন্যতম লক্ষ্য ছিলেন বুদ্ধবাবু নিজেই। তার পরিপ্রেক্ষিতে শুক্রবার সন্ধ্যায় বুদ্ধবাবুকে জবাবি বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ দিয়েছিল দল। বস্তুত, বিধানসভা নির্বাচনে ভরাডুবির পরে এই প্রথম দলের অন্দরে ‘আত্মপক্ষ সমর্থন’ করলেন বুদ্ধবাবু। সিপিএম সূত্রের খবর, প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে সেই বক্তৃতায় এ দিন পলিটব্যুরো সদস্য বুদ্ধবাবু সরাসরিই বলেন, ধর্মঘট সম্পর্কে যা বলেছিলেন, তা ‘ভুল’ হয়েছিল। কোনও পরিস্থিতিতেই ওই ভুল আর হবে না। তাঁর স্বীকারোক্তি শুনে তৎক্ষণাৎ করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রতিনিধিরা। যাঁরা আগাগোড়া তাঁর সমালোচনা করে গিয়েছেন!
প্রসঙ্গত, মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বণিকসভার এক অনুষ্ঠানে বুদ্ধবাবু মন্তব্য করেছিলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনক’ ভাবে তিনি এমন একটি দল করেন, যারা ধর্মঘট করে! তাঁর ওই মন্তব্য নিয়ে তোলপাড় হয় বামপন্থী শিবিরে। বাম শরিকেরা তো বটেই, সিপিএমের পলিটব্যুরোর একটি অংশ ক্ষোভ প্রকাশ করে। কলকাতায় নজরুল মঞ্চে হরকিষেণ সিংহ সুরজিতের স্মরণসভায় মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবুকে মঞ্চে বসিয়েই তাঁর ওই মন্তব্যের জন্য ‘ভর্ৎসনা’ করেছিলেন রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু। পরবর্তী কালে বামফ্রন্টের নির্বাচনী বিপর্যয়ের পর্যালোচনায় এবং এ বারের রাজ্য সম্মেলনেও বারেবারে সমালোচনা হয়েছে, বুদ্ধবাবুর ওই মন্তব্য শ্রমিক শ্রেণির সঙ্গে বামেদের ‘দূরত্ব’ বহু যোজন বাড়িয়ে দিয়েছিল। সমালোচনার মুখে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এ বার ধর্মঘট-প্রশ্নে অন্তত দলের অন্দরে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেলেন!
সিঙ্গুর নিয়ে হাজার সমালোচনার মুখে বুদ্ধবাবু এ দিন প্রকট করে দিয়েছেন রতন টাটার প্রতি তাঁর ‘অভিমান’। বলেছেন, ‘অবাঞ্ছিত অতিথি’ হয়ে এখানে থাকব না, টাটা হঠাৎ এমন কথা বলে বসলেন, যখন কারখানার কাজ ৮০% হয়ে গিয়েছে! ‘মাথায় বন্দুক ধরে থাকতে বললে থাকব না’, এ সব বলে চলে গেলেন! বুদ্ধবাবুর ব্যাখ্যা, তিনি পরে বুঝেছিলেন, গুজরাতের সরকারের সঙ্গে সব বন্দোবস্ত হয়েছিল। তাই শেষ লগ্নে হঠাৎ ‘মত পরিবর্তন’ হয়েছিল টাটার। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবুর
বিরুদ্ধে অভিযোগ, ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সিঙ্গুরে ‘মাচা বেঁধে’ তিনি বসতে দিয়েছিলেন। বুদ্ধবাবুর মন্ত্রিসভার সহকর্মী গৌতম দেবও এই নিয়ে তাঁর মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করেছেন অতীতে। বুদ্ধবাবু এ দিন সেই সমালোচনা খণ্ডন করেছেন এই বলে আর কোনও উপায় ছিল না। সিঙ্গুরের পথ থেকে তৎকালীন বিরোধী নেত্রীকে একাধিক বার ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারই ‘হতাশা’য় বিধানসভায় ‘তাণ্ডব’ চালিয়েছিল তৃণমূল। বিরোধীদের ‘হতাশা’র বহিঃপ্রকাশ ভয়ঙ্কর হচ্ছে দেখেই বাধা দেওয়ার রাস্তায় তখন আর হাঁটতে পারেনি রাজ্য সরকার।
দলের ভিতরে-বাইরে অভিযোগ আছে, বাম সরকারের শেষ তিন বছর রাজ্যে প্রশাসন বলে কার্যত কিছু ছিল না। সেই অভিযোগের জবাবে বুদ্ধবাবুর সাফাই, ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটের পরেই প্রশাসন চালানো ‘কঠিন’ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রশাসনের ‘মাথাটা’ তাঁদের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। ‘মাথা’দের রাশ টেনে আটকানোর চেষ্টা ‘সফল’ হয়নি! নন্দীগ্রামে গুলি চালানো যে ‘দুর্ভাগ্যজনক’, তা অবশ্য ফের কবুল করেছেন রাজ্য প্রশাসনের প্রাক্তন কর্ণধার। মেনে নিয়েছেন, বামপন্থী সরকার গুলি চালাচ্ছে, এই ঘটনা মানুষ মেনে নেননি।
বাম সরকারের চলার পথে ভুল-ভ্রান্তি হয়েছিল, জমি অধিগ্রহণে তাড়াহুড়ো হয়েছিল, কৃষকদের আরও বোঝানোর দরকার ছিল এত সব কিছু মেনে নিয়েও তাঁর শিল্পায়নের নীতির পক্ষেই জোরালো সওয়াল করতে ছাড়েননি বুদ্ধবাবু। যুক্তি দিয়েছেন, শিল্প এনে নয়া উদারনীতিকে তিনি সমর্থন জুগিয়েছেন এই সমালোচনা যথার্থ নয়। শিল্পনীতি নেওয়ার সময়েই ঠিক হয়েছিল, উদারনীতির ‘মৌলিক বিরোধিতা’ করলেও তার ‘সুযোগ’ নিতে হবে। ভারতের বাকি সব রাজ্য বৃহৎ শিল্প করবে আর বাংলায় শুধু মাঝারি বা ক্ষুদ্র শিল্প হবে, এ অবস্থান নেওয়া সম্ভব ছিল না। তাঁর যুক্তি, সিঙ্গুরে হাজার একর নিয়ে এত হট্টগোল, অথচ ৬০০০ একর জমি নিয়েও শিল্প হয়েছে। সিঙ্গুরের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো হয়েছিল। আর নন্দীগ্রামে জমি নেওয়ার কোনও সরকারি পদক্ষেপ না-হলেও ‘নৈরাজ্য’ তৈরি করে রাখা হল দীর্ঘ দিন। এ সবের জেরেই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর আক্ষেপ “যার জন্য কারখানা, সে (মানুষ) না-বুঝলে ‘বিপদ’!” তাঁর বক্তব্য, উন্নয়নের পথে এগোতে হবে, এ কথা দলের কর্মসূচিতেই আছে।
বুদ্ধবাবুর বক্তব্যের আগে এ দিন দার্জিলিং জেলায় গোর্খাদের পৃথক জাতিসত্তা মেনে নেওয়ার ব্যাপারে সম্মেলনে প্রস্তাব পেশ করে রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য বলেন, জাতিসত্তা নিয়ে গোর্খাদের দাবি সঠিক। কিন্তু তা নিয়ে যে ভাবে পাহাড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন করা হচ্ছে, সিপিএম তার বিরোধিতা করে। বর্তমান পৃথিবীতে ‘আত্মপরিচয়’ বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর বলে মন্তব্য করে অশোকবাবু বলেন, কোথাও জাত, কোথাও ভাষা এমনকী, পেশা বা জমিও কোনও আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতি। কোনও কমিউনিস্ট দল তা উপেক্ষা বা অস্বীকার করতে পারে না। কিন্তু সেই আত্মপরিচয়কে কেন্দ্র করে বুর্জোয়া দলগুলি যে রাজনীতি করে, তার বিরোধিতা করাই কমিউনিস্ট দলগুলির নীতি। বুদ্ধবাবুও তাঁর বক্তৃতায় উল্লেখ করেন, পরিচিতিসত্তার আন্দোলনে একটা ‘গণতান্ত্রিক উপাদান’ আছে। কিন্তু দুনিয়া জুড়ে তাকে উস্কে দিচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি।
সম্মেলনে আজ, শনিবার জবাবি ভাষণ দেওয়ার কথা রাজ্য সম্পাদক বিমানবাবুর। তার পরে তৈরি হবে নতুন রাজ্য কমিটি। পর দিন, রবিবার ব্রিগেড সমাবেশের মধ্যে দিয়ে রাজ্য সম্মেলন পর্ব শেষ হবে। তবে এই প্রশ্ন সিপিএমকে ভাবাবেই, যা এ দিন তুলেছেন বুদ্ধবাবু: এত মানুষ সিপিএমের বিরুদ্ধে। তাঁরা কবে ফিরবেন, প্রশ্ন সেটাই! |
|
|
|
|
|