|
|
|
|
|
|
|
ব্যাগ গুছিয়ে... |
ক্যানভাসে মুক্তির রং
বিনসর তো আসলে কুমায়ুনের দুয়োরানি। প্রকৃতিও তাই তাল মিলিয়ে
প্রতি দিনের শ্রেষ্ঠ দৃশ্যগুলো নিয়ে আসে দিনের শেষে। লিখছেন সুদীপ ঘোষ |
|
ডাইনিং রুমে হঠাৎ হইচই। “ইয়ে ক্যা! চিকেন কা কোই আইটেম নেহি হ্যায়!”
নাহ! চিকেনের ‘ডিম’ ছাড়া আর কোনও ‘আইটেম’ নেই। খাবার মানে নির্ভেজাল কুমায়ুনি নিরামিষ।
কিন্তু কলকাতা থেকে আসা গোটা দশ জনের দলটাকে সে কথা কে বোঝাবে! আলমোড়া বেড়াতে এসে বিনসরের নাম শুনে এখানে দু-রাত্তিরের জন্য চলে এসেছেন সকলে। আর চারপাশটা দেখে একবারও মনে হয়নি জায়গাটা রিজার্ভ ফরেস্ট হওয়ার কোনও চান্স আছে। দিব্যি পাকা রাস্তা, পাহাড় পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠে গেছে, এ দিক ও দিক থেকে উঁকি মারছে হিমালয়ের এ চুড়ো, ও চুড়ো। রাস্তার পাশে কোথাও উঁচু-নিচু পান্নার মতো চকচকে ঘাস ভরা উপত্যকা, কোথাও একটু ঘন জঙ্গল। অন্যান্য হিল স্টেশনের সঙ্গে পার্থক্য একটাই — বাড়িঘর প্রায় নেই বললেই চলে।
তাই রাতের খাবারে চিকেনটা আসবেই এটা ধরে নিয়েছিলেন তাঁরা। ওই যেমন আলমোড়ায় পেয়েছিলেন আর কি। না পেয়ে রাজ্যের বিরক্তি। কিন্তু জঙ্গলে একবার ঢুকে পড়লে তো নন-ভেজ চলবে না!
এটাই বিনসর। হিল-স্টেশন তো অবশ্যই, আসলে কিন্তু জঙ্গল। যে জঙ্গলে বেশ ভয়ঙ্কর সব প্রাণীর আস্তানা। পাকা রাস্তা থেকে পাকামি মেরে একটু অ্যাডভেঞ্চার করতে ডান দিক-বাঁ দিক করেছেন কি ভালুক আর লেপার্ডের মুখোমুখি হতে পারেন যে কোনও মুহূর্তে। আবার সেই মুহূর্তটা কখনওই নাও আসতে পারে। জানোয়ারের ব্যাপার। নিজেদের মর্জিমাফিক চলাফেরা করে। তাই দিনের আলোয় দেখা দেওয়ার চান্স মোটামুটি কুয়াশা ঢাকা নন্দাকোট চুড়োর মতোই। তবে রাতের বেলা...বলা যায় না।
বলা যায় না বলেই সূর্য ডুবল কি আপনি এখানে হোটেলবন্দি হয়ে গেলেন। তা হলে কী করবেন? ওই যে বললাম হিল স্টেশন নৈঃশব্দ্যে গা ডুবিয়ে বসে থাকবেন।
সে কারণেই বিনসর হয়তো সকলের জন্য নয়। এখানে মোবাইলের টাওয়ার থাকে না, নেটের কানেকশনও না। বিবিএম নেই, ট্যুইটারও না।
তা হলে কী আছে? |
|
আছে কোমল শীত থেকে ভীষণ শীত। আছে রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে গুটি গুটি পায়ে রাস্তা হাঁটা। একাও হতে পারে। বা দু’জনে। বা কয়েক জনে। সবুজে সবুজ, গাছের গায়ে ঘন পর্ণাঙ্গ। কানে কানে হাওয়া। বা জঙ্গলের শিরশিরে চুপকথা। পান্না-পান্না উপত্যকায় বিনেশ্বর মহাদেবের ছোট্ট মন্দির, কিন্তু তার চত্বরে বসে পাওয়া প্রশান্তির অনুভূতিটা বিরাট।
আর আছে সামনে ছড়ানো কুমায়ুনী হিমালয়ের চুড়ো একের পর এক। ট্যুরিস্ট ব্রোশারে সেটাই প্রধান আকর্ষণ। ৩০০ কিমি চওড়া সিনেমাস্কোপে হিমালয়ের এক টুকরো। এত বিরাট, এত বিশাল এবং এত বিস্তৃত যে তার দিকে চোখ গেলে জাগতিক হিসেব-নিকেশ কেমন যেন গুলিয়ে যায়। মজা হল, এখানে এলে সেই বিরাটত্বের সামনে আপনাকে দাঁড়াতেই হবে।
বিনসর হয়তো আলমোড়া, কৌশানি, রানিখেতের মতো বিখ্যাত নয়। কিন্তু এই এলাকায় এটাই একমাত্র হিল-স্টেশন যেখান থেকে হিমালয়ের ২৪টি চুড়োকে এক নজরে দেখতে পাওয়া যায়। নন্দাদেবী, নন্দাকোট, চৌখাম্বা, ত্রিশূল, পঞ্চচুলি, কেদারনাথ তার মধ্যে ক’টাই বা? এই ২৪-কে ঘিরেই বিনসরের জীবন যাপন। ঝকঝকে দিনে সূর্যোদয়ের পরেও থেকে যায় একটানা পাহাড়ের গায়ে আলোর নানা কবিতাপঙক্তি। তার পর আসবে নাটকীয় সূর্যাস্ত। বিনসর তো আসলে কুমায়ুনের দুয়োরানি। প্রকৃতিও তাই তাল মিলিয়ে প্রতি দিনের শ্রেষ্ঠ দৃশ্যগুলো নিয়ে আসে দিনের শেষে। স্রেফ লাল আর সিলিউটে সারাক্ষণ পাল্টে যাওয়া এমন একটা অগাধ-আকাশ ক্যানভাস একমাত্র ছবি দিয়েই বোঝানো যায়। অথবা মন দিয়ে!
ভাষা কখন যে এখানে নৈঃশব্দ্যের প্রতিধ্বনিতে আড়ষ্ট হয়ে যায়, বোঝাও যায় না।
ট্যুইটার, বিবিএম, ফেসবুক, গলা পর্যন্ত জড়িয়ে থাকা সারাক্ষণের, সারা দিনের ক্লান্তিকর যোগাযোগগুলোও তাই কুঁকড়ে অদৃশ্য হয়ে যায় নিরবিচ্ছিন্ন প্রশান্তির সামনে।
ওই যে বললাম, এখানে জাগতিক হিসেব-নিকেশ কেমন যেন গুলিয়ে যায়!
|
কী ভাবে যাবেন |
কাঠগোদাম স্টেশন থেকে গাড়ি। বিনসর পৌঁছতে লাগবে ঘণ্টা ছয়েক।
একেবারে শুনশান জায়গা। গাড়িটা সঙ্গে রাখুন। |
সেরা সময় |
অক্টোবর-নভেম্বর, আবার ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল। ডিসেম্বর-জানুয়ারিটা এড়ানোই ভাল,
যদি না ভীষণ শীতে কাঁপন ধরানো জায়গায় যেতে ভালবাসেন। |
কী করবেন |
হাইল্যান্ড ট্রেকিংয়ের আদর্শ জায়গা। বিনসর-ধৌলাচিনা-বৃহদজ্ঞেশ্বর-দণ্ডেশ্বর রুট।
বেসরকারি বেশ কয়েকটি সংস্থা এই ধরনের ট্রেকিংয়ের ব্যবস্থা করে। স্রেফ বিনসর গেলে দূরবিন রাখুন।
এখানে দু’শোরও বেশি ধরনের পাখির বাস।
গাড়ি নিয়ে চলে যেতে পারেন হাজার বছরেরও বেশি
পুরনো যোগেশ্বর মন্দির।
চন্দ্রবংশীয় রাজাদের গ্রীষ্মকালীন
রাজধানী ছিল এখানে।
বিনেশ্বর
মহাদেবের মন্দিরও
সে সময়েই তৈরি।
পাহাড়ের গা বেয়ে প্রচুর পায়ে-চলা পথ আছে। |
|
সে সব ধরে এমন সব জায়গায় পৌঁছে যাবেন, যার হদিস কোনও ট্যুরিস্ট ব্রোশার দিতে পারবে না। নিজে
ট্রেকিং
করলে গাইড নিন। শক্তিশালী টর্চ রাখবেন সঙ্গে। সূর্য ডোবার পরে কোনও ভাবেই রেস্ট হাউসের
চৌহদ্দির
বাইরে বেরোবেন না। যে কোনও সময় ভালুকের মুখোমুখি হতে পারেন।
লেপার্ডের থেকেও
ভয়ঙ্কর ভালুক। লেপার্ড আপনাকে এড়াবার চেষ্টা করবে। ভালুক আক্রমণ করবে। |
|
মনে রাখবেন |
বিনসরের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাত হাজার ফুটেরও বেশি।
চার দিকে বরফ ঢাকা পাহাড়।
তার ওপর জঙ্গুলে জায়গা। সে কারণে দিনে এবং রাতে নানা সময়ে
নানা রকম
তাপমাত্রা পাবেন।
তবে সবই কমের দিকে। গরমজামা অবশ্যই নেবেন। |
কোথায় থাকবেন |
অভয়ারণ্যের মধ্যে থাকার জায়গা দু’টি। কুমায়ুন মণ্ডল বিকাশ নিগমের গেস্ট হাউস। ডবল বেড বুকিং মানে
সঙ্গে ব্রেকফাস্ট আর ডিনার ধরা আছে। লাঞ্চ করলে আলাদা পয়সা লাগবে। মেনু নিরামিষ। স্নানের জন্য
ভোরবেলা গরম জল দেওয়া হয়। তার পর সারা দিন আর গরম জল পাবেন না। এ ছাড়া ফরেস্ট রেস্ট হাউস বুক
করতে
হলে
আলমোড়ার বন দফতরে যোগাযোগ করতে হবে। ফোন: ০৫৯৬২-২৩০০৬৫। বনবাংলোতে
থাকলে কিন্তু আলমোড়া থেকে পুরো বাজার করে ঢুকতে হবে। ওখানকার কেয়ারটেকার রান্না করে দেবেন।
তবে তার জন্য আলাদা টাকা লাগবে। অভয়ারণ্যের বাইরেও থাকার বেসরকারি জায়গা আছে। |
|
|
|
|
|
|
|