|
|
|
|
|
|
নাগরিক প্রয়াস |
...চল নিজেরাই বদলাই |
শান্তনু ঘোষ |
ভ্যাট উপচে পড়ছে রাস্তায়। বাড়ির সামনে আগাছার জঙ্গল। রাস্তায় নোংরা আবর্জনা ভর্তি। দুর্গন্ধে নাকে রুমাল চাপা দিয়ে হাঁটতে বাধ্য হচ্ছেন বাসিন্দারা।
ডুমুরজলা হাউসিং কমপ্লেক্স ও আশপাশের বাসিন্দাদের কাছে এগুলি খুবই চেনা ছবি। কিন্তু প্রতি দিনের অতি পরিচিত সেই ছবিটাই ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। ভ্যাটের ময়লা জমছে নির্দিষ্ট ঘেরা জায়গাতে। সপ্তাহে এক দিন সাফাই হচ্ছে এলাকা। আগাছার জঙ্গলের জায়গায় তৈরি হয়েছে ফুলের বাগান।
অবশ্য এই চেনা ছবি বদলানোর কাণ্ডারী ডুমুরজলা হাউসিং কমপ্লেক্সের আবাসিকেরাই।
ড্রেনেজ ক্যানাল রোডের ধারে হাওড়া পুরসভার ৪২ ও ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত ডুমুরজলা আবাসন। আশির দশকের গোড়ার দিকে দ্বিতীয় হুগলি সেতু তৈরির সময় শিবপুর অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা অধিগ্রহণ করে রাজ্য সরকার, হাওড়া উন্নয়ন সংস্থা (এইচআইটি) এবং হুগলি রিভার ব্রিজ কমিশনার্স (এইচআরবিসি)। সে সময় যে সব বাসিন্দার বাড়ি ভাঙা হয়েছিল পুনর্বাসন প্রকল্পের অধীনে তাঁদের ডুমুরজলা আবাসনে ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছিল।
|
|
বাসিন্দাদের অভিযোগ, পুনর্বাসনের সময় উন্নয়নমূলক কাজের একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ৩০ বছর কেটে গেলেও আজও একটি প্রতিশ্রুতিও বাস্তবায়িত হয়নি। পুরসভার কোনও পরিষেবাও পৌঁছয় না এই আবাসনে। আবার আবাসনটি এইচআইটি-র হলেও তাদের থেকেও কোনও পরিষেবা মেলে না। ফলে বাধ্য হয়েই আবর্জনা সাফাই থেকে শুরু করে আবাসন মেরামতি, পানীয় জলের ব্যবস্থা সবই আবাসিকদের নিজেদেরই করতে হয়। যদিও এইচআইটি-র চিফ ইঞ্জিনিয়ার মৃন্ময় চট্টোপাধ্যায় বলেন, “আমরা সাধ্যমতো পরিষেবা দিই। কিন্তু নাগরিক পরিষেবা দেওয়ার কাজ পুরসভার। এ বিষয়ে সম্প্রতি পুরসভার সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তারা বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করবে বলে জানিয়েছে। তবে ওই এলাকায় স্যুয়ারেজ লাইন তৈরির জন্য আমরা শীঘ্রই কাজ করব।”
হাওড়ার মেয়র মমতা জয়সোয়াল বলেন, “ডুমুরজলা আবাসন থেকে আমরা কোনও ট্যাক্স পাই না। তবে আবাসিকেরা তা দিতে রাজি। কিন্তু ওঁদের মিউটেশন নেই বলে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। এইচআইটি-কে বলেছি ফ্ল্যাটগুলি আবাসিকদের নামে রেজিস্ট্রি করে দিতে। তা হলে মিউটেশন করা যাবে। আমরা আবাসিকদের পরিষেবা দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছি।”
দীর্ঘ দিন ধরে এই অবস্থা চলার পরে কয়েক মাস আগে থেকে ডুমুরজলা হাউসিং কমপ্লেক্সের বেশ কয়েক জন বাসিন্দা উদ্যোগী হয়েছেন আবাসন চত্বরের সৌন্দর্যায়নে। সেই কাজ করতে গিয়ে তাঁরা ‘সৃজনী’ নামে একটি সংস্থা তৈরি করেছেন। প্রবীণ ও নবীন মিলিয়ে যার সদস্য সংখ্যা বর্তমানে ১৭০। তাঁরা প্রতিটি আবাসনের সামনের আগাছার জঙ্গল সাফাই করে সেখানে তৈরি করেছেন বিভিন্ন প্রজাতির গাছের বাগান। রাস্তার পাশের যে ভ্যাট থেকে ময়লা আবর্জনা উপচে পড়ত সেটি এখন টিন দেওয়া ঘেরা। আবার বিভিন্ন গাছগাছালির মধ্যে আবাসনের দেওয়ালে বিভিন্ন মনীষীর ছবির সঙ্গেই আঁকা হয়েছে সমাজ সচেতনতার ছবি। দেওয়ালে আছে কার্টুনও। সপ্তাহে এক দিন নিজেরাই পালা করে রাস্তার আবর্জনা সাফাই করতে নামছেন সদস্যরা। |
|
কিন্তু আচমকা এই পরিকল্পনা কেন?
‘সৃজনী’র সদস্যরা জানান, পুরসভা এবং এইচআইটি-র চাপানউতোরে যখন দীর্ঘ দিন ধরে ডুমুরজলা হাউসিং কমপ্লেক্স নোংরা, আবর্জনায় ভরে থাকছিল, তখন নিজের নিজের ফ্ল্যাটের পরিচর্যার পাশাপাশি একত্রিত হয়ে গোটা আবাসন চত্বর সাজানোর পরিকল্পনা শুরু করেন কয়েক জন প্রবীণ বাসিন্দা। পরে এগিয়ে আসেন আবাসনের অল্পবয়সীরাও। তাঁদেরই এক জন চার্বাক রায়ের কথায়: “বয়স্কদের দেখে বন্ধুরা মিলে ঠিক করলাম, আমাদেরও কিছু করা দরকার। তার পর থেকে সবাই মিলেই আবাসন চত্বর সাজানোর কাজে হাত লাগিয়েছি।”
সম্প্রতি ডুমুরজলা হাউসিং কমপ্লেক্স চত্বর ঘুরে চোখে পড়ে, অধিকাংশ আবাসনের সামনের রাস্তায় আগাছার জঙ্গল উধাও। সেখানে রঙিন বাঁশ দিয়ে তৈরি হয়েছে ছোট্ট বাগান, যেখানে শোভা পাচ্ছে মেহগনি, এরিকা পাম, ডালিয়া, গাঁদা, গোলাপের মতো হরেক প্রজাতির গাছ। প্রতিটি বাগানেই রয়েছে বৃক্ষরোপণ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড। রয়েছে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করার বার্তাও। সৃজনীর সদস্যরা জানালেন, বাগান দেখভাল করার জন্য এক জন মালি আছেন। তবে তাঁরা নিজেরাও নিয়মিত বাগানগুলির দেখভাল করেন। |
|
ডুমুরজলা হাউসিং কমপ্লেক্সের মধ্যেই রয়েছে দু’টি পুকুর। তার মধ্যে দুধের ডিপোর পাশে একটি পুকুরের পাড়ের জঙ্গল, আবর্জনা সাফাই করে সেখানেই তৈরি হয়েছে ছোট্ট শিশু উদ্যান। কেউ যাতে পুকুরে আবর্জনা বা পুজোর ফুল, প্লাস্টিক না ফেলে নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলেন তারও ব্যবস্থা রয়েছে। এগিয়ে এসেছেন মেয়েরাও। যেমন, অর্পিতা দাস বললেন, “ছোট বাগানগুলি তৈরির পাশাপাশি আবাসনের দেওয়ালে আমরা বিভিন্ন ছবি আঁকছি। তাতে মানুষকে সচেতন করার সঙ্গেই দেখতেও ভাল লাগছে।” সৃজনী-র সম্পাদক প্রশান্ত পালের কথায়: “গাছ লাগানো, এলাকা সাফাই করার পাশাপাশি আবাসনের বাসিন্দারা মিলে মাঝেমধ্যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও করি। এই সব কাজের জন্য প্রতিটি সদস্য মিলে মাসিক চাঁদা দিয়ে তহবিল বানিয়েছি। সেখান থেকেই এর খরচ উঠছে।” |
|
|
|
|
|