দেশের মধ্যে এক শহর হইতে অন্য শহরে যাওয়ার জন্য স্বেচ্ছায় সরকারি বিমানসংস্থা এয়ার ইন্ডিয়ার টিকিট কাটিতে চাহেন, এমন মানুষ সম্ভবত সংখ্যায় খুব বেশি নয়। কিন্তু, আন্তর্জাতিক উড়ানের ক্ষেত্রে ভারতীয় বিমানসংস্থার যাত্রী হইতে চাহিলে এত দিন কার্যত এয়ার ইন্ডিয়া ভিন্ন গত্যন্তর ছিল না। কারণ, আন্তর্জাতিক উড়ানে ভারতের বেসরকারি বিমানসংস্থাগুলির সম্প্রসারণের উপর কঠোর সরকারি নিয়ন্ত্রণ ছিল। কেন? সরকারি যুক্তি ছিল, এয়ার ইন্ডিয়া-ই ভারতের জাতীয় বিমানসংস্থা, ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এই বিমানটি একমাত্র হওয়াই বিধেয়। ইহা যুক্তি নহে, অজুহাত। ক্ষতির ঘরের বাসিন্দা সরকারি বিমানসংস্থাটিকে অযৌক্তিক সুবিধা দেওয়ার অজুহাত। এত দিনে বোধোদয় হইয়াছে। নিয়ম বদলাইতেছে। এখন ভারতীয় বেসরকারি বিমানসংস্থাগুলিও আন্তর্জাতিক গন্তব্যে উড়ানের অধিকারী হইতেছে। হঠাৎ এই বোধোদয় কেন? দেনার দায়ে এয়ার ইন্ডিয়া এমনই বিপর্যস্ত যে সরকারও তাহার বোঝা বহন করিতে নাচার, তাই কি এই শুদ্ধিকরণ? কারণ যাহাই হউক, সিদ্ধান্তটি স্বাগত। অভ্যন্তরীণ বিমান পরিবহণে দেড় দশকেরও অধিক সময় পূর্বে যে ‘মুক্ত আকাশ’ নীতি গৃহীত হয়, এই সিদ্ধান্ত তাহারই বহুবিলম্বিত সম্প্রসারণ। লক্ষণীয়, প্রধানমন্ত্রী বেশ কয়েক মাস ‘দ্বিতীয় প্রজন্মের সংস্কার’ শব্দবন্ধটি উচ্চারণ করেন নাই। কথায় না বলিয়া কাজে করিয়া দেখানো অধিকতর কাম্য বটে। ‘জাতীয় বিমানসংস্থা’ বস্তুটি ঠিক কী? অনুমান করা চলে, এয়ার ইন্ডিয়া যেহেতু সরকারি সংস্থা, সেই কারণেই তাহাকে জাতির স্কন্ধে স্থাপন করিবার এই অপচেষ্টা। এই চেষ্টার একটিই কারণ থাকিতে পারে সরকারি মহল এখনও উদার অর্থনীতির অর্থ অনুধাবন করিতে পারে নাই। প্রথমত, সরকার কেন একটি বিমানসংস্থা চালাইবে, তাহার কোনও যুক্তি নাই; আর দ্বিতীয়ত, সরকারি বিমানসংস্থাকে ‘জাতীয়’ তকমা দিয়া তাহাকে অন্যায্য সুবিধা করিয়া দেওয়া চলিতে পারে না। দেশের বাজারে যেমন এয়ার ইন্ডিয়া-কে (পূর্বতন ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স) বেসরকারি বিমানসংস্থাগুলির সহিত প্রতিযোগিতা করিতে হয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তাহাই হইবে। ঘরের প্রতিযোগিতায় এয়ার ইন্ডিয়া নাস্তানাবুদ হইতেছে, বাহিরেও ব্যতিক্রম হওয়ার কারণ নাই। বস্তুত, বহির্যাত্রীরা নিতান্ত বাধ্য না হইলে এয়ার ইন্ডিয়ার ধারেকাছে ঘেঁষেন না। বিমানসংস্থাটির এই অবস্থার প্রধান কারণ: সংস্থাটি মজ্জায় মজ্জায় অকুশলী। অকুশলতার মূলে সরকারি রক্ষাকবচ। সংস্থার ক্ষতি হইলে সরকার রাজকোষ উজাড় করিয়া সেই ভার বহন করিবে, এই বিশ্বাস আর পাঁচটি সরকারি সংস্থার ন্যায় এয়ার ইন্ডিয়াতেও বদ্ধমূল। ফলে, কুশলী হইয়া উঠিবার উদ্যোগের বড় অভাব। সরকারকে বুঝিতে হইবে, করদাতাদের অর্থে অলাভজনক সংস্থাকে পোষণ করিবার অধিকার তাহার নাই। এয়ার ইন্ডিয়া যদি প্রতিযোগিতার বাজারে, নিজের সামর্থ্যে টিকিতে পারে, তবে সে থাকিবে, নচেৎ বিলুপ্ত হওয়াই শ্রেয়। জাতীয়তাবোধের মলম লাগাইয়া এই ব্যাধির চিকিৎসা সম্ভব নহে। |