সমকামিতা সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলিয়াছে সুপ্রিম কোর্ট। ইতিপূর্বে দিল্লি হাইকোর্ট সমকামিতাকে অপরাধের তকমা-মুক্ত করার যে রায় দিয়াছিল, তাহার বৈধতাকে প্রশ্ন করিয়া শীর্ষ আদালতে যে-সব মামলা হয়, তাহার শুনানি চলাকালে মাননীয় বিচারপতিদের বক্তব্য সমাজ বদলাইতেছে, কিছু কাল আগেও যাহা গর্হিত বলিয়া মান্য ছিল, সেই বিবাহ-বহির্ভূত সহবাস কিংবা গর্ভ ভাড়া দেওয়ার মতো ঘটনা আজ স্বাভাবিক বলিয়া গণ্য। অন্তত, সমাজপতিদের রক্তচক্ষুর ভয়ে মানুষ আর এই সব অনুশীলন হইতে বিরত হয় না। এই পরিবর্তনের সহিত সামঞ্জস্য রাখিয়াই সামাজিক নৈতিকতা ও আইনেরও পরিবর্তন জরুরি। শীর্ষ আদালতের এই বক্তব্য সাধুবাদযোগ্য।
বিচারপতিরা প্রসঙ্গত দুইটি বিষয়ের অবতারণা করিয়াছেন, যাহা তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁহারা জানাইয়াছেন, ১৮৬০ সালের আগে সমকামিতা ভারতে অপরাধ বলিয়া গণ্যই হইত না। অর্থাৎ সমকামিতা বিষয়ে সমাজের রক্তচক্ষু কোনও শাশ্বত ভারতীয় ব্যাপার নয়, ভিক্টোরীয় যুগের ব্রিটিশ ভারত-শাসকদের একটি কুসংস্কার প্রজাদের উপর আইন করিয়া চাপাইয়া দিবার ঘটনা। ব্রিটিশ ভিক্টোরীয় মূল্যবোধ আবার একান্ত ভাবেই খ্রিস্টীয় তথা সেমিটিক নৈতিকতার ধারাবাহিকতা, যে নৈতিকতা যৌনতাকে কেবল সন্তান উৎপাদনের জন্য আবশ্যক আচরণ বলিয়া গণ্য করে, তাহার অতিরিক্ত কোনও ভূমিকা তাহার জন্য মঞ্জুর করে না। স্বভাবতই সেই নৈতিকতায় যৌনতা পছন্দ-নিরপেক্ষ এবং সম্ভোগ-অতিরিক্ত একটি পবিত্র সামাজিক ও ধর্মীয় কর্তব্য। যৌনতা সম্পর্কে এই ভিক্টোরীয় তামসিকতাই এ দেশের বিবিধ সমাজ সংস্কার আন্দোলনকে আচ্ছন্ন করে, যাহা যৌনতাকে সন্তান উৎপাদনের ঐশ্বরিক ইচ্ছাপূরণের সোপানমাত্র গণ্য করে। (এখানে বিচারপতিরা সূক্ষ্ম ইঙ্গিতে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সেই চমৎকারের উল্লেখ করিয়াছেন, যাহার সাহায্যে সন্তান প্রজননের জন্য এখন আর নারীপুরুষের দৈহিক মিলনের প্রয়োজন হয় না। ফলে সমকামী দম্পতিরাও পিতৃত্ব বা মাতৃত্বের স্বাদ পাইতেছেন।) পরবর্তী কালে হিন্দুত্ববাদীরাও এই জড়ত্বপ্রাপ্ত ভাবনাকে শাশ্বত হিন্দু নৈতিকতা রূপে তুলিয়া ধরিতে সচেষ্ট থাকিয়াছেন। কিন্তু সনাতন ভারতীয় তথা হিন্দু যৌনতার ধারণা, তত্ত্ব ও অনুশীলন অনেক উদার, বহুমুখী ও বহুমাত্রিক ছিল। তাহাতে ভিক্টোরীয় বামনাইয়ের আড়ষ্টতা ও ভণ্ডামি ছিল না।
হিন্দু সমাজে এই বহুমাত্রিক যৌনতার প্রসঙ্গেই বিচারপতিরা খাজুরাহোর মন্দিরগাত্রে উৎকীর্ণ ভাস্কর্যমালার উল্লেখ করিয়াছেন। খাজুরাহো ও কোনারকের মন্দির-ভাস্কর্যে বিকল্প যৌনতা হিসাবে সমকামিতার উদ্যাপন অকুণ্ঠ ও উচ্ছল। কোনও রাখ-ঢাক না-করিয়াই সেখানে নারীর বহুগামিতা যেমন চিত্রিত, তেমনই পুরুষ ও নারীর সমকামী যৌনতাও উন্মোচিত। বাৎস্যায়নের কামসূত্রেও সমকামিতার স্বীকৃতি রহিয়াছে। সুতরাং ইহাকে অস্বাভাবিক যৌনাচার বলিয়া চিত্রিত করা কেবল অজ্ঞতা নয়, অনৈতিহাসিকও। ঔপনিবেশিক শাসকদের তৈয়ার করা একটি আইনের দোহাই পাড়িয়া এত কাল সমকামিতাকে অপরাধ গণ্য করাটাই বরং একটা অপরাধ। সমকামিতার মূলে আছে যৌনসঙ্গী নির্বাচনের স্বাধীনতা, যাহা গণতন্ত্রে ব্যক্তির অপরিহার্য অধিকার রূপেই স্বীকৃত হওয়া উচিত, কেননা পছন্দের স্বাধীনতাই গণতন্ত্র। আর ‘অস্বাভাবিক’ বা ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ’ তকমাগুলিও আজ আর বিজ্ঞানসম্মত নয়। প্রাণিজগতে সমকাম যৌনতা কেবল মানুষ নয়, মনুষ্যেতরদের মধ্যেও রীতিমত প্রবল। প্রাণিবিদ্যার গবেষণা ও অনুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণে এ সত্য আজ প্রমাণিত। তা ছাড়া, অধিকাংশ লোক যাহা ভাবে বা করে, তাহাই ‘স্বাভাবিক’, বিপরীতটা ‘অস্বাভাবিক বিচ্যুতি’, এই যুক্তিও তর্কশাস্ত্রে টেকে না। কারণ আজ যাহা অল্প লোকে সীমাবদ্ধ, কাল তাহাই বহুজনে ব্যাপ্ত হইতে পারে, হইয়া থাকে। সংখ্যা বা শতাংশের আধিক্য বা স্বল্পতা দিয়া কোনও প্রবণতার স্বাভাবিকতা-অস্বাভাবিকতা মাপা যায় না। সেই প্রবণতার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা নিরূপণ করিতে হইলে সমাজকেই পাল্টাইতে হইবে। বিচারকের উচ্চাসনে বসিয়া নৈতিকতার সংজ্ঞা নির্ধারণ করিলে চলিবে না। |