রেল ব্যবস্থাকে নিশ্ছিদ্র করতে আগামী পাঁচ বছরে যাত্রী সুরক্ষা খাতে এক লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার পরামর্শ দিল নিরাপত্তা সংক্রান্ত উচ্চ পর্যায়ের কমিটি। পাশাপাশি ওই টাকার একটি বড় অংশ উপার্জনের জন্য প্রয়োজনে যাত্রী ভাড়ায় ‘সেফ্টি সারচার্জ’ বসানোর পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। কমিটি আয়ের ওই রাস্তা দেখালেও প্রশ্ন হচ্ছে, রেল মন্ত্রক কি আগামী বাজেটে টিকিট-পিছু নিরাপত্তা খাতে ওই টাকা নেওয়ার মতো বলিষ্ঠ
সিদ্ধান্ত নিতে পারবে? তা নিয়ে সংশয় রয়েছে শীর্ষ রেলকর্তাদেরই মধ্যে।
গত সেপ্টেম্বরে কানপুরের কাছে কালকা মেল দুর্ঘটনার ঠিক পরেই যাত্রী-নিরাপত্তায় যাতে কোনও ফাঁক না থাকে, তা নিশ্চিত করতে এবং বর্তমান পরিকাঠামো খতিয়ে দেখার জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের নিরাপত্তা কমিটি গঠন করেন রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী। পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অনিল কাকোদকরের নেতৃত্বাধীন ওই কমিটি আজ ওই রিপোর্ট জমা দেয়। কমিটিতে কাকোদকর ছাড়াও ছিলেন প্রাক্তন রেলকর্তা ই শ্রীধরন, বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টারের এন বেদাচলম, আইআইটি কানপুরের অধিকর্তা সঞ্জয় ধান্ধে, ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারের অধিকর্তা জি পি শ্রীবাস্তব।
কমিটি রিপোর্টে রেলের কড়া সমালোচনা করেছে। তারা বলেছে, রেলের আর্থিক পরিস্থিতি প্রায় ভেঙে পড়ার মুখে। দীর্ঘ ন’বছর ধরে যাত্রী ভাড়া না বাড়ানোয় আর্থিক ভিত কার্যত নড়ে গিয়েছে রেলের। পরিকাঠামো না বাড়িয়ে সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে বাজেটে নতুন ট্রেন ঘোষণা করার যে দীর্ঘ পরম্পরা রয়েছে, তা বন্ধ হওয়া উচিত বলে মনে করছে কমিটি। রেলের যাত্রী সুরক্ষার বিষয়টি দেখার জন্য কোনও স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটি কেন নেই, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে রেল মন্ত্রক।
রেলের ভাঁড়ার যে খালি, তা আজ ফের পরোক্ষে মেনে নিয়েছেন রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী। কেন্দ্র যদি অবিলম্বে সাহায্য না করে, তা হলে অচিরেই রেলের অবস্থা এয়ার ইন্ডিয়ার মতো হবে বলে জানান দীনেশ। কেন্দ্রের কাছে রেলকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। তাঁর কথায়, “এয়ার ইন্ডিয়ার পুনরুজ্জীবনে কেন্দ্র ১৯ হাজার কোটি টাকা দিচ্ছে। আর রেলকে সামগ্রিক ভাবে কুড়ি হাজার কোটি টাকার সাহায্য করেছে। অথচ রেলে প্রতিদিন দু’কোটি মানুষ সওয়ার হন। আর বিমানে বছরে কয়েক লক্ষ। তাই নিরাপত্তার পাশাপাশি সামগ্রিক ভাবে রেলকে আধুনিক রূপ দিতে পাঁচ লক্ষ কোটি টাকা প্রয়োজন রেলের।” বিশেষজ্ঞরাও এই দাবি মেনে নিয়ে আজ বলেছেন, আম-আদমির স্বার্থেই রেলের পরিকাঠামোগত উন্নয়নে বিপুল আর্থিক সাহায্য দেওয়া উচিত কেন্দ্রের। তা ছাড়া, শুধু সুরক্ষা কমিটির সুপারিশ মানতে হলে নিরাপত্তা খাতেই বছরে কুড়ি হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে রেলকে।
নিরাপত্তা সংক্রান্ত খোলনলচে বদলে ফেলতে ওই প্রভূত পরিমাণ অর্থ কোত্থেকে আসবে, তা নিয়ে সরাসরি কোনও জবাব দিতে চাননি দীনেশ। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সাহায্য, মন্ত্রকের নিজস্ব আয়, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ মডেল, বাজার থেকে ঋ
ণ নিয়ে অর্থ জোগাড় করে মন্ত্রক। যদিও সেই টাকার মাত্র ১৪ শতাংশ খরচ হয় নতুন পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজে। তার মধ্যে রেল সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে নতুন লাইন পাতা, গেজ পরিবর্তন করা, কিংবা বিদ্যুদয়নের কাজে। ফলে সুরক্ষা খাতে ওই বিপুল অর্থের জোগাড় কোথা থেকে হবে, সেই প্রশ্ন আজ ঘুরে ফিরে উঠেছে। বিশেষজ্ঞ কমিটি অবশ্য যাত্রীদের উপর সেফ্টি সারচার্জ ছাড়াও ফি বছর নিরাপত্তা খাতে কেন্দ্রীয় সাহায্য বৃদ্ধি করা, রেলের জমি থেকে আয় করার প্রস্তাব দিয়েছে রেল মন্ত্রককে। পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, আগামী পাঁচ বছর কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রককে ডিভিডেন্ড না দিয়ে সেই অর্থ নিরাপত্তা খাতে ব্যয় করা হোক। তবে আয় করার যে সুপারিশগুলি রয়েছে, সেগুলি কিছুটা হলেও জনবিরোধী সিদ্ধান্ত। তাই এ সব সিদ্ধান্ত কি আদৌ নিতে পারবে রেল মন্ত্রক? প্রশ্ন সেটা নিয়েই। |