এক দিনে জোড়া ধাক্কা কংগ্রেস শিবিরে। জাতীয় সন্ত্রাস মোকাবিলা কেন্দ্র (এনসিটিসি) গঠন নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ অ-কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রীদের সরাসরি বিরোধিতা আজ অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে মনমোহন সরকারকে। একই দিনে বিপর্যয়ের খবর এল মুম্বই থেকে। গত তিন বার বিরোধী আসনে বসার পরে এ বারই প্রথম পুরভোটের আগে শরদ পওয়ারের দল এনসিপি-র সঙ্গে জোট বেঁধেছিল কংগ্রেস। কিন্তু বৃহন্মুম্বই পুরসভার ভোটে তা-ও ভাগ্য ফিরল না কংগ্রেসের। কংগ্রেস-এনসিপি জোটকে ধরাশায়ী করে মুম্বইয়ে ফের ‘জয়ধ্বজা’ ওড়াল শিবসেনা-বিজেপি। কিছু নির্দল সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন হলেও এই নিয়ে টানা চতুর্থ বারের জন্য বৃহন্মুম্বই পুরসভায় সেনা-বিজেপি বোর্ড গঠন এখন অনিবার্য।
বিপুল অঙ্কের বাজেটে বৃহন্মুম্বই পুর বোর্ডের। এর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব পাওয়ারও গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু দেশের বাণিজ্য রাজধানীতে এই হার জাতীয় স্তরেও অস্বস্তিতে ফেলল কংগ্রেসকে। টুজি-স্পেকট্রাম থেকে এনসিটিসি, একের পরে এক সমস্যায় জেরবার মনমোহন সরকার। এখন আবার ভোট চলছে উত্তরপ্রদেশে। সংশয় নেই, এই পরিস্থিতিতে মুম্বইয়ে সাফল্য পেলে তা শক্তি জোগাতে পারত দশ জনপথকে। কিন্তু মুম্বই শক্তি জোগাল কেন্দ্রের বিরোধী পক্ষকে। স্বাভাবিক ভাবেই উজ্জীবিত শিবসেনা, উৎফুল্ল বিজেপি।
ক’দিন আগেই মুম্বইয়ের ভোটকে ‘ইউপিএ’ বনাম ‘এনডিএ’-র লড়াই আখ্যা দিয়েছিলেন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী পৃথ্বীরাজ চহ্বাণ। বলতে গেলে, চহ্বাণের সেই বলটাই আজ ঘুরিয়ে বাউন্ডারি পার করাতে চাইলেন বিজেপি নেতা তথা রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা অরুণ জেটলি। মুম্বই পুরভোটের ফলকে জাতীয় রাজনীতির উঠোনে টেনে এনে জেটলির ঘোষণা, “মুম্বই বুঝিয়ে দিল, কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অনাস্থার ঢেউ উঠেছে দেশ জুড়ে। আর শিবসেনা নেতা সঞ্জয় রাউতের বক্তব্য, “মুম্বই কষিয়ে চড় দিয়েছে কংগ্রেস-এনসিপি-র গালে।” এখন কী বলছেন চহ্বাণ? বলছেন, “এই ফল অপ্রত্যাশিত, বিস্ময়কর। আমরা ধর্মনিরপেক্ষ ভোট একজোট করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেই লক্ষ্য পূরণ করা যায়নি।” শিবসেনা-প্রধান বালসাহেব ঠাকরে ও উদ্ধব ঠাকরেকে অভিনন্দন জানিয়ে তাঁর মন্তব্য, “ আত্মসমীক্ষা করতে হবে।”
শুধু মুম্বই নয়, মহারাষ্ট্রে দশটি পুরসভা ও জেলা পরিষদের নির্বাচন হয়েছে গত কাল। আজ সকাল থেকে শুরু হয়েছে তার গণনা। বৃহন্মুম্বই পুরসভার মোট আসন ২২৭টি। জয় ও গণনায় এগিয়ে থাকার নিরিখে সর্বশেষ যে হিসেব পাওয়া গিয়েছে, তা এই রকম, সেনা-বিজেপি জোট ১০৭ (জাদুসংখ্যার চেয়ে ৭ কম), কংগ্রেস-এনসিপি জোট ৬৪, বালসাহেব ঠাকরের ভাইপো রাজ ঠাকরের মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা ২৮ (২০০৭-এর চেয়ে ৮ বেশি)। পাশাপাশি ঠানে ও নাগপুর পুরসভার দখল নিয়েছে সেনা-বিজেপি। তবে পুণেতে এনসিপি কংগ্রেস জোট আধিপত্য বজায় রাখতে সফল হয়েছে। যদিও রাজনৈতিক মর্যাদার প্রশ্নে স্বাভাবিক ভাবেই মুম্বই নিয়ে হইচই বেশি। সেনা-বিজেপি জোট সেখানে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকায় মানুষের কমবেশি অসন্তোষ ছিলই। কিন্তু তা কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে ডাহা ফেল কংগ্রেস। এনসিপি-র সঙ্গে জোট না হলে কংগ্রেসের ফল যে আরও ভয়াবহ হত, তা-ও নিশ্চিত। রাজ ঠাকরে শিবসেনার ভোট না কাটলে হয়তো বা মুম্বইয়ে ‘স্যুইপ’ করত সেনা-বিজেপি। তবু আজ হয়তো সব থেকে খুশির দিন বালসাহেব ঠাকরের। তাঁর সাম্রাজ্যের উত্তরসূরি হিসাবে পুত্র উদ্ধবকেই দেখতে চেয়েছিলেন বালসাহেব। তাতে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছিলেন রাজ ঠাকরে। আজকের ফলাফলে স্পষ্ট, উদ্ধবের নেতৃত্বেই শেষ পর্যন্ত আস্থা জানাল মুম্বই। কংগ্রেস এখন অস্বস্তি লুকোতে যুক্তি দিচ্ছে, খুব কম মানুষ ভোট দেওয়াতেই এই ফল। তা ছাড়া, গোটা মহারাষ্ট্রে মাত্র একটি পুরসভা ছিল কংগ্রেসের দখলে। তা হল শোলাপুর। কিন্তু এ বার পুণে, অমরাবতী, শোলাপুর-সহ ৩-৪টি পুরসভায় কংগ্রেস ক্ষমতা দখলের পথে। একই সঙ্গে জেলা পরিষদে ভাল ফল করেছে কংগ্রেস। কংগ্রেসের মতোই কম ভোট পড়াকে দায়ী করছেন রাজ ঠাকরে।
কিন্তু নানান যুক্তি সাজালেও এখন প্রশ্নের মুখে কংগ্রেস। প্রতিষ্ঠানবিরোধী ভোট বুথমুখী না করতে পারার জন্য প্রশ্ন তুলছেন কেন্দ্রীয় নেতারাই। রাজ্য কংগ্রেসে কোন্দল নিয়ে প্রকাশ্যে ক্ষোভ জানিয়েছেন এনসিপি নেতা পওয়ার। তাঁর কথায়, “কংগ্রেসের গোষ্ঠী কোন্দলের কারণে এনসিপি-রও ফল খারাপ হল।” কংগ্রেস সূত্রেও বলা হচ্ছে, খুব একটা ভুল বলেননি পওয়ার। আদর্শ আবাসন কেলেঙ্কারির প্রেক্ষাপটে মুখ্যমন্ত্রী পদের দায়িত্ব নিয়েছিলেন চহ্বাণ। কিন্তু তিনি সব বিষয়ে এত বেশি ‘সতর্ক’ যে, কংগ্রেস নেতারাই তাতে অসন্তুষ্ট ছিলেন। বিলাসরাও দেশমুখ, অশোক চহ্বাণের মতো প্রাক্তন কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রীরা নিজের নিজের এলাকা ছাড়া অন্যত্র নিষ্ক্রিয় ছিলেন। একই ভাবে সক্রিয় ছিলেন না গুরুদাস কামাতের মতো মুম্বইয়ের নেতারা। নইলে যে কংগ্রেস মুম্বইয়ে লোকসভা ও বিধানসভা ভোটে এগিয়ে ছিল, তারই এমন ভরাডুবি কেন?
মুম্বইয়ের লড়াইকে ইউপিএ বনাম এনডিএ-র দ্বৈরথ আখ্যা দিয়েও বিপদ বাড়িয়েছেন পৃথ্বীরাজ। বস্তুত কংগ্রেসকে কেন্দ্রে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে তাঁর এই মন্তব্যই। সেই মত থেকে আজ দূরত্ব রাখতে চেয়েছে কংগ্রেস হাইকম্যান্ড। দলের মুখপাত্র রেণুকা চৌধুরির কথায়, “পুরভোটে নির্ণায়ক ভূমিকা নেয় স্থানীয় বিষয়, তার সঙ্গে জাতীয় রাজনীতির সম্পর্ক নেই।” দলে পৃথ্বীরাজের অপসারণের দাবিও উঠতে শুরু করে দিয়েছে। কংগ্রেস নেতৃত্ব এখন উত্তরপ্রদেশ নিয়ে চিন্তিত। সেখানে ভোট শেষ হলেই মহারাষ্ট্রের ময়নাতদন্ত হবে। তবে দলের এক কেন্দ্রীয় নেতার কথায়, “হাইকম্যান্ডকেও বুঝতে হবে, মহারাষ্ট্র কেমন নেতা চায়। সেখানে পৃথ্বীরাজের মতো স্রেফ মূল্যবোধের রাজনীতি হয়তো অকেজো। বরং বিলাসরাওয়ের মতো দাপুটে নেতার প্রয়োজন, বাস্তবের জমির সঙ্গে যাঁর যোগ রয়েছে।”
বিপরীতে উজ্জীবিত বিজেপি। মুম্বইয়ের কৃতিত্বের বারো আনা শিবসেনার হলেও, জাতীয় স্তরে বিজেপি-র মনোবল বেড়েছে অনেকটাই। উত্তরপ্রদেশে এখনও চার দফার ভোট বাকি। তার আগে এমন একটা ‘খুশির খবর’ কর্মীদের উৎসাহ বাড়াবে বলে আশাবাদী সভাপতি নিতিন গডকড়ী। দু’বছর পর নাগপুর আসন থেকে লোকসভা ভোটে প্রার্থী হতে চান তিনি। তার আগে নাগপুরে ও মুম্বইয়ে তাঁর নিজের ‘গড়ে’ দলের ভোট সাফল্য নিতিন গডকড়ীর পায়ের তলার জমি আরও শক্ত করল বলেই মনে করছেন বিজেপি-র একাংশ নেতৃত্ব। তবে গডকড়ী আজই এ ব্যাপারে খুব উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেননি। তাঁর কথায়, “মহারাষ্ট্রে সেনা-বিজেপি-র ভাল ফল খুশির খবর। তাতে এ-ও প্রমাণিত যে কংগ্রেসের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে মানুষ।” |