|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
আলোর সঙ্গে অন্ধকারের দ্বৈত মানবী সত্তা |
সম্প্রতি হিমাদ্রি অ্যাপার্টমেন্টে অনুষ্ঠিত হল শানু লাহিড়ির একক প্রদর্শনী। ঘুরে এলেন মৃণাল ঘোষ। |
শানু লাহিড়ি এখন আমাদের দেশের অন্যতম প্রবীণতমা শিল্পী। চিত্রকলার ক্ষেত্রে নিজস্ব একটি ঘরানা তিনি তৈরি করেছেন, যা ১৯৫০ বা ১৯৬০-এর দশকের প্রচলিত ধারাগুলি থেকে অনেকটাই আলাদা।
মানবীচেতনা থেকে উৎসারিত সেই শিল্পরূপ সমস্ত কলুষের ভিতর থেকে সৌন্দর্যকে বের করে আনে। সেই সৌন্দর্যের দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি অনেক সময় প্রতিবাদী অবস্থানও নেন। মানবিক দুঃখ ও করুণার আলেখ্যও উঠে আসে। কিন্তু সেই তীব্রতাকেও তিনি সুস্মিত আলোকে সিঞ্চিত করে নিতে পারেন। এখন প্রায় ৮৫ বছর বয়সেও তিনি তন্ময় ভাবে সৃজনশীল। শুধু চিত্র বা ভাস্কর্য সৃজন নয়, শিল্প-আলোচনা ও নানা সাংগঠনিক কাজেও তিনি সারা জীবন নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন এবং রাখেন।
তাঁর শিল্পকৃতির এই বৈশিষ্ট্যগুলো আমরা আবার অনুধাবন করতে পারলাম সম্প্রতি অনুষ্ঠিত তাঁর ছবি ও ভাস্কর্যের একটি প্রদর্শনীতে। বালিগঞ্জের হিমাদ্রি অ্যাপার্টমেন্টে অনুষ্ঠিত হল তাঁর ৬১টি কাজ নিয়ে প্রদর্শনী। সব কাজই সম্প্রতি বা দু’এক বছরের মধ্যে করা। জীবনকে দেখার আলোকিত দৃষ্টিকোণের পরিচয় আবারও পাওয়া গেল এই প্রদর্শনীতে।
প্রায় ছয় দশক বা তারও বেশি সময় ধরে নিরন্তর শিল্পচর্চায় নিমগ্ন আছেন তিনি। ১৯৪৬ সালে কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫১-তে পাশ করেন। সে বছরই আর্ট স্কুল কলেজে উন্নীত হয়। পাশ করে বেরোনোর আগেই ১৯৫০-এ অনুষ্ঠিত হয় তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী। সেই থেকে তাঁর জীবন ও শিল্পকর্ম একাত্ম হয়ে আছে। তাঁদের পরিবারে হয়তো তাঁর পিতার প্রভাবেই ছিল ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডল। তাঁর দুই দাদা কমলকুমার ও নীরদ মজুমদারের ছবিতেও অধ্যাত্মচেতনার প্রকাশ খুব স্পষ্ট। |
|
শিল্পী: শানু লাহিড়ি |
শানু লাহিড়ির ছবিতে ধর্মচেতনার কোনও প্রত্যক্ষ ছাপ নেই। তবে বিষয় হিসেবে পুরাণকল্প অনেক সময় এসেছে তাঁর ছবিতে। এর বাইরে দৃশ্যমান বাস্তবই রূপান্তরিত হয়। তাতে যুক্ত হয় সৌন্দর্যের দীপ্তি। সেই সৌন্দর্যে থাকে বাস্তব-অতিক্রান্ত পরোক্ষ এক আধ্যাত্মিকতার বিভা।
১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত তিনি প্যারিসে শিল্পের পাঠ নেন। এবং নিবিষ্ট ভাবে ওখানকার সমস্ত শিল্প-সংগ্রহ দেখেন। তা তাঁকে আপ্লুত ও খানিকটা বিহ্বল করে। কিন্তু প্যারিসে যাওয়ার আগে থেকেই ফরাসি আধুনিকতা তাঁকে কিছুটা প্রভাবিত করে। সেটা ছিল সেই সময়েরই একটি বৈশিষ্ট্য। নব্য-ভারতীয় ঘরানার অতীতচেতনা থেকে মুক্ত করতে হবে ছবিকে। অ্যাকাডেমিক স্বাভাবিকতার আঙ্গিকেও সম্ভাবনা কিছু নেই।
এই দুই প্রচলিত পথকে ছাড়িয়ে নতুন ভাষা খুঁজছিলেন পঞ্চাশ ও ষাটের শিল্পীরা। সেটাই তাঁদের প্রাণিত করেছিল পাশ্চাত্য আধুনিকতাকে নিজেদের ঐতিহ্য ও জীবনবোধের সঙ্গে সমন্বিত করে নতুন চিত্রভাষার সন্ধানে। শানু লাহিড়ি রেখার সারল্যে ও বর্ণের বিন্যাসে ছবিতে নিয়ে এসেছেন আলোর জ্যামিতি। মোজাইকধর্মী সেই জ্যামিতি থেকেই তাঁর ছবিতে আসে আলোকিত সৌন্দর্যের অনুরণন। সেই আলোতে কখনও কখনও ছায়ারও বিস্তার ঘটে।
ডিসেম্বর ২০০৯-এ আঁকা একটি ছবি, এক নারী বসে আছে শরীর একটু এলিয়ে। শুভ্রতারই নানা প্রচ্ছায়ার মোজাইকে গড়ে উঠেছে অবয়ব। মুখাবয়বের কোনও বিশদ নেই। শুধু একটি উপবৃত্তের উপস্থাপনা থেকে প্রতিফলিত হচ্ছে আলো। আর সেই মেয়ের কালো চুলের ঢল ছড়িয়ে পড়েছে চিত্রক্ষেত্রের অনেকটা পরিসর জুড়ে। আলোর সঙ্গে অন্ধকারের এই দ্বৈত মানবী সত্তার অন্তর্লোককে যেন উদ্ভাসিত করে তোলে।
আবার ২০১২-তে আঁকা একটি ক্যানভাসে দেখি পশু ও পাখির সমাবেশের ভিতর দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন অসামান্য জঙ্গমতা। ধূসরে আঁকা একটি ছুটন্ত গরু ক্যানভাসের অনেকটা জুড়ে বিস্তৃত। তার পাশেই রয়েছে একটি কৃষ্ণাভ নীল ছাগল। হলুদ একটি পাখি অবস্থান করছে গরুটির ঠিক উপরে।
আর যেন খানিকটা অন্ধকারের বার্তা নিয়ে উপরে বিস্তৃত ডানা মেলে উড়ছে একটি বড় পাখি। আলো অন্ধকারের দ্বৈত রয়েছে এই জঙ্গমতার মধ্যে। এই দ্বৈতের ভিতর দিয়েই শিল্পী তুলে আনেন তাঁর নিজস্ব বার্তা। পশু-পাখি তাঁর খুবই প্রিয় বিষয়। নানা আঙ্গিকে বার বার তাদের আঁকেন।
১৯৬৩-তে ‘মায়ের স্বপ্ন’, ১৯৬৬-তে পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীতের উপর করা ছবি, ১৯৬৯-তে ‘রাবণ ও সীতা’, ১৯৮২-তে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ ইত্যাদি নানা চিত্রমালায় এই শিল্পীর যে বিস্তৃত পরিক্রমা, সেই প্রজ্ঞারই সংহত রূপ আমরা দেখি এই প্রদর্শনীতে। |
|
|
|
|
|