বাংলার বিকৃতি চলবে না,
রায় ঢাকা হাইকোর্টের
ভাষা আন্দোলনের দেশে ভাষার শুচিতা রক্ষায় এ বার নামতে হল আদালতকে।
ইদানীং ‘বাং-লিশ’ বা ‘বাং-হিং-লিশ’, অর্থাৎ বাংলার সঙ্গে ইংরেজি বা হিন্দি মিশিয়ে কথা বলার যে চল টিভি বা এফএম রেডিও-র উপস্থাপকদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে, তাই নিয়েই আপত্তি জানিয়েছে আদালত। এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশের একটি দৈনিকে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ হাইকোর্টের নজরে এনেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে রকিব উদ্দিন। তার পরেই গত কাল আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রায় দিয়েছে, ‘বেতার বা দূরদর্শনে বাংলা ভাষাকে ব্যঙ্গ করা বা বিকৃত উচ্চারণে প্রচার করা যাবে না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের লেখা ওই প্রবন্ধের শিরোনাম ‘ভাষাদূষণ নদীদূষণের মতোই বিধ্বংসী’। এখনকার ‘রেডিও জকি’ বা সঞ্চালকরা বাংলা-ইংরেজির মিশ্রণে ‘বাংলিশ’-এ কী ভাবে কথা বলেন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তার নমুনা দিয়েছেন প্রবন্ধে। যেমন, ‘ফ্রেন্ডসরা, এই অফার কিন্তু ভ্যালিড টিল ফোর্টিনথ। সো মনে রেখো...।’ এই খিচুড়ি ভাষা ব্যবহারেরই সমালোচনা করেছেন মনজুরুল।
প্রবন্ধের বিষয়ে জানার পরে বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী এবং বিচারপতি জাহাঙ্গির হোসেনের বেঞ্চ রুল জারি করে বলেছে, ‘বাংলা ভাষার পবিত্রতা রক্ষায় সর্বতো ভাবে চেষ্টা করতে হবে। এ ভাষার উপরে যাতে আর কোনও আঘাত না আসে, সে বিষয়ে সচেষ্ট হতে হবে।’ যে সব রেডিও বা টিভি চ্যানেলে ভাষা বিকৃত করা হয়, তাদের বিরুদ্ধে কেন আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, সেই প্রশ্নও তুলেছে আদালত। এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে সংস্কৃতি সচিব, তথ্যসচিব-সহ বিভিন্ন পদাধিকারীকে। একই সঙ্গে বাংলা ভাষার দূষণ, বিকৃত উচ্চারণ, সঠিক শব্দ চয়ন না-করা এবং ভাষার অবক্ষয় রোধে একটি কমিটির গঠনেরও পরামর্শ দিয়েছে হাইকোর্ট।
কয়েক দিন পরেই ২১ শে ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ভাষা-আন্দোলনের ৬০ বছর পূর্তি হচ্ছে এই বছর। যে দেশে বাংলা ভাষার জন্য মানুষ শহিদ হয়েছেন, সেই দেশেই ভাষা-বিকৃতি রুখতে আদালতকে তৎপর হতে হল কেন?
বর্ষীয়ান ভাষা সৈনিক ও বাংলাদেশে রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্রের প্রাক্তন প্রধান আহমেদ রফিকের সাফ কথা, শেষ পর্যন্ত আদালতের নির্দেশে যদি কাজের কাজ কিছু হয়, সেটাই হবে পাওনা। অনেক আগে সরকারের সচেষ্ট হওয়া উচিত ছিল। যে ভাবে রেডিও-টেলিভিশনে বাংলার বিকৃতি চলছে, নতুন প্রজন্ম সেই বিকৃতিকেই স্বাভাবিক জেনে অনুকরণ করে চলেছে, তা মহা বিপদের সৃষ্টি করেছে। সংস্কৃতি কর্মীরা অনেক দিন ধরে বিষয়টি নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেও হেরে গিয়েছেন। আহমেদ রফিক বলেন, পশ্চিমবঙ্গেও একই সমস্যা। সেখানে ইংরেজির পাশাপাশি হিন্দিরও আগ্রাসনের শিকার বাংলা ভাষা। তাঁর প্রশ্ন, এত সমৃদ্ধ বাংলা ভাষা। তবু বাঙালির হীনমন্যতা কেন থাকবে?
আদালতের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে ভাষা সৈনিকদের সংগঠন ‘একুশে চেতনা পরিষদ’-ও। সংগঠনের নেতা কামাল লোহানি বলেন, তাঁরা দিনের পর দিন বিষয়টি নিয়ে দরবার করে গিয়েছেন। কিন্তু সরকারকে মাতৃভাষা রক্ষায় উদ্যোগী করা যায়নি। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গণপরিষদে বাংলা ভাষার দাবিতে প্রথম সরব হয়েছিলেন কংগ্রেসের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। কিন্তু তাঁর স্মরণে বাংলাদেশের কোথাও একটি স্মারকও নেই। কামাল লোহানি জানান, মার্চে ঢাকায় ভাষা সৈনিকদের সম্মেলন ডাকা হয়েছে। তার আগে হাইকোর্টের রায় বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে গেল।
কিন্তু এই ভাবে আদালতের মাধ্যমে ভাষার শুদ্ধতা রক্ষা কি সম্ভব?
পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন, “বিভিন্ন চরিত্রের প্রয়োজনে ভাষার একটু হেরফের হয়। এটা মুক্ত মনে মেনে নিতে হবে। সব বিষয়ে গোঁড়া হওয়া কাজের কথা নয়।”
বাংলা ভাষার দূষণ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে, তা স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা দরকার বলে জানাচ্ছেন পবিত্র সরকার। তাঁর মতে, অতিরিক্ত ইংরেজির ব্যবহারটা দূষণ, না এফএম-এ ইংরেজি টানে বাংলা বলাটা দূষণ, সেটা স্পষ্ট না হলে বিভ্রান্তি ছড়াবে। আদালতের নির্দেশে গঠিত কমিটিকেই বিষয়টা পরিষ্কার করতে হবে বলে জানিয়েছেন পবিত্রবাবু। তাঁর মতে, ‘‘একে ভাষার উপরে খবরদারিও মনে হতে পারে। কারও কারও মনে হচ্ছে এই নির্দেশ আঞ্চলিক ভাষার উপরে নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু আঞ্চলিক ভাষার মর্যাদাও একফোঁটা কম নয়।” কলকাতার রেডিও-টিভি-র নিয়মিত সঞ্চালক মীর কিন্তু বলছেন, “বাংলাদেশে, যেখানে ভাষার জন্য এত জন প্রাণ দিয়েছেন, সেখানে আদালতের এমন নির্দেশের আলাদা তাৎপর্য রয়েছে। তবে এই নির্দেশের প্রেক্ষাপটটা আমার জানা নেই। কিন্তু ভাষা বা উচ্চারণের হেরফের ঘটিয়ে পরশুরাম-শিবরাম চক্রবর্তীদের মতো অনেকেই মজা করেছেন। পরশুরাম যেমন লিখেছিলেন, ‘হয়, হয়, zানতি পারো না।’ একটি বিষয়ও মাথায় রাখতে হবে, আদালতের রায় চাপিয়ে দেওয়ার মধ্যে ভাষা নিয়ে কোনও ধরনের নিরাপত্তাহীনতা নেই তো?” নিরাপত্তহীনতা নয়, বাংলাদেশের আদালত অবশ্য চিন্তিত ভাষার স্খলন নিয়ে। তাই হাইকোর্টের সাফ কথা, ‘বাংলা আজ কেবল বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, অসম, ত্রিপুরার ভাষা নয়। আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত একটি ভাষা। এই ভাষার উপরে অত্যাচার চলছে। আমাদের জাতিসত্তার অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই এটা রোধ করতে হবে।’



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.