এত দিন গ্রামে চিকিৎসা সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরিকাঠামো গড়তে বেসরকারি সহায়তা চাওয়া হচ্ছিল। এ বার গ্রামে চিকিৎসক পাঠাতেও বেসরকারি মদত নিতে হচ্ছে রাজ্য সরকারকে। আর এ জন্য স্বাস্থ্য দফতর গাঁটছড়া বাঁধছে সেই সব সংস্থার সঙ্গে, যারা শহর থেকে নিয়মিত ডাক্তার নিয়ে গিয়ে গ্রামের মানুষদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে থাকে। প্রথম দফায় পুরুলিয়ার পারা ব্লকে এমনই এক বেসরকারি সংস্থা পরিচালিত চক্ষু হাসপাতালকে তিন জেলার রেফারেল চক্ষু হাসপাতালের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
সেখানে কলকাতার নামী চিকিৎসকেরা নিয়মিত গিয়ে অস্ত্রোপচার করছেন।
পাশাপাশি প্রত্যন্ত গ্রামে ডাক্তারদের ক্যাম্প বসাচ্ছে যে সব সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল, বিভিন্ন জেলায় তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ, সংক্ষেপে পিপিপি ভিত্তিতে) হাসপাতাল তৈরির চুক্তিও করছে সরকার। প্রথম ধাপে দুর্গাপুরের এমনই এক বেসরকারি হাসপাতালকে শিলিগুড়িতে জমি দেওয়া হচ্ছে, আড়াইশো শয্যার আর একটা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল গড়ার উদ্দেশ্যে।
স্বাস্থ্য-কর্তারা এ-ও জানাচ্ছেন, গ্রামে পরিষেবা পৌঁছে দিতে আগ্রহী সংস্থাগুলোকে এক ছাতার তলায় আনার কথা ভাবা হচ্ছে। কারণ, বেসরকারি উদ্যোগে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা মিললে আখেরে সাধারণ মানুষেরই লাভ। স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তার কথায়, “গ্রামে ডাক্তার পাঠাতে গেলে সেখানে তাঁদের থাকা, ছেলেমেয়ের স্কুল, বিনোদন ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে হবে, যা রাতারাতি সম্ভব নয়। তাই যারা শহর থেকে ডাক্তার নিয়ে গিয়ে গ্রামে নিয়মিত পরিষেবা জোগানোর দায়িত্ব নিতে পারবে, সরকার তাদেরই বেছে নেবে।” মূলত এই কারণেই পুরুলিয়ার পারা ব্লকের হাসপাতালটিকে বেছে নেওয়া হয়েছে। ওখানে ২০০৮ ইস্তক চোখের চিকিৎসা চলছে। মাসে গড়ে অন্তত এক হাজার ছানি কাটানো হয়, আউটডোরে চিকিৎসা হয় আট হাজার রোগীর। কাজটা মূলত করেন শহরের ডাক্তারেরাই। গ্রামে দিনভর রোগী দেখে, মাটির অতিথিশালায় রাত কাটিয়ে সকালে তাঁরা কলকাতায় ফেরেন। ওঁঁদের কাজের সাফল্য স্বাস্থ্য-কর্তারাও যাচাই করে নিয়েছেন। এবং তারই ফলশ্রুতি হিসেবে পুরুলিয়ার ওই হাসপাতালকে চোখের চিকিৎসার ক্ষেত্রে বাঁকুড়া-পুরুলিয়া-পশ্চিম মেদিনীপুরের ‘রেফারেল’ হাসপাতাল হিসেবে চিহ্নিত করেছে রাজ্য সরকার।
হাসপাতালটির পরিচালক সংগঠনের সম্পাদক রঞ্জনা সেনগুপ্ত বলেন, “এতে যে শুধু গ্রামবাসীর হয়রানি কমছে তা-ই নয়, শহরের হাসপাতালেও চাপ কমেছে।” এমনকী, ওখানে অস্ত্রোপচারের পরে ফলো-আপের জন্য রোগীদের আসতে হয় না, হাসপাতালেরই মোবাইল ভ্যান রোগীর দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়। জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের রাজ্য-অধিকর্তা দিলীপ ঘোষের মন্তব্য, “এঁদের কাজকর্ম সত্যিই প্রশংসনীয়। ডাক্তারেরা গ্রামে যেতে চান না, এটা সর্বাংশে ঠিক নয়। অনেকেই নিয়মিত গ্রামে গিয়ে রোগী দেখছেন। আসলে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা হাতে হাত মিলিয়ে চললে আমজনতারই উপকার। আমরা সেই লক্ষ্যেই এগোচ্ছি।” স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর: এর পরে পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর হাসপাতালের শিশু বিভাগটিও বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া যায় কি না, সে বিষয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে। বস্তুত ‘পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ’ ছাড়া স্বাস্থ্য-পরিষেবার জাল রাজ্যের সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া যে কার্যত অসম্ভব, মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং তা একাধিক বার স্বীকার করেছেন। যদিও স্বাস্থ্যমহলের একাংশের অভিযোগ, এ ব্যাপারে কর্তাদের মধ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাব রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে গরিবকে চিকিৎসাদানের বিচ্ছিন্ন বেসরকারি প্রয়াসগুলোকে সংগঠিত রূপ দিতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা একান্ত জরুরি বলে মনে করছেন অনেকে। যেমন, দুর্গাপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতাল ফি মাসে প্রত্যন্ত জেলায় গিয়ে ক্যাম্প করছে। বাস বোঝাই করে যাচ্ছেন ডাক্তার-নার্স-টেকনিশিয়ানরা। যাচ্ছে চিকিৎসা সরঞ্জাম। শিবিরে সম্পূর্ণ নিখরচায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা রোগী দেখছেন। হাসপাতালটির চেয়ারম্যান তথা কার্ডিওথোরাসিক চিকিৎসক সত্যজিৎ বসুর কথায়, “গ্রামের মানুষের পক্ষে শহরে গিয়ে জটিল রোগের চিকিৎসা করানো যে কী যন্ত্রণার, তা তাঁরাই জানেন। আমরও সেটা টের পাচ্ছি।
দীর্ঘ দিন ধরে হার্টের অসুখে ভুগছেন, অথচ কখনও চিকিৎসা করাননি, এমন লোকজনও প্রচুর পাচ্ছি। তাঁদের কাছে উন্নত পরিষেবা পৌঁছে দেওয়াটাই আমাদের ‘মিশন’।” সত্যজিৎবাবুদের দাবি, গ্রামের ওই সব ক্যাম্পেই বহু শিশুর জটিল হৃদ্রোগ নির্ণয় করা হয়েছে। “বারোটা বাচ্চার ওপেন হার্ট সার্জারি করেছি আমরা। ক্যাম্পেই তাদের রোগ ধরা পড়েছিল। গরিবঘরের শিশু হৃদ্রোগীদের অপারেশনের জন্য আমাদের বিশেষ প্রকল্পও রয়েছে।” বলেন তিনি। ওঁদের হাসপাতালের তরফে বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ছাড়াও দার্জিলিংয়ের গ্রামাঞ্চলে ক্যাম্প হয়েছে। শহর থেকে মফস্সলে গিয়ে চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার কাজ হচ্ছে একেবারে ব্যক্তিগত স্তরেও।
কলকাতার বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের অভিজ্ঞ ডাক্তারেরা জেলায় গিয়ে নিখরচায় রোগী দেখে আসছেন। অনেকে আবার জেলায় কাজ করতে আগ্রহী, কিন্তু কী ভাবে সম্ভব বুঝতে পারছেন না। রাজ্যের স্বাস্থ্য-কর্তারা জানিয়েছেন, স্থায়ী ভাবে না-থেকে যাঁরা প্রতি সপ্তাহে গ্রামে গিয়ে রোগী দেখতে তৈরি, তাঁদের নামের তালিকা তৈরি হবে। |