বছরও ঘোরেনি, বিধানসভা নির্বাচনে তাঁরা দু’জনেই ছিলেন দলের ‘মুখ’। ক্ষমতা হারানোর পরে সিপিএমের প্রথম রাজ্য সম্মেলনে তাঁরা দু’জনেই হয়ে দাঁড়িয়েছেন যাবতীয় আক্রমণের প্রায় কেন্দ্রবিন্দু! সম্মেলনের রুদ্ধকক্ষে সারা রাজ্য থেকে আসা প্রতিনিধিদের সামনে প্রায় কাঠগড়ায় তুলে বিচার হচ্ছে দু’জনের!
প্রথম জন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তাঁর নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের ‘ব্যর্থতা’ থেকে শুরু করে দিনের পর দিন দলের পলিটব্যুরো এবং কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে যোগ দিতে না-যাওয়ার জন্য যিনি কাঠগড়ায়। দ্বিতীয় জন বিগত বাম মন্ত্রিসভায় তাঁর সহকর্মী গৌতম দেব। প্রমাণ ছাড়া ‘অকমিউনিস্ট-সুলভ অভিযোগ’ করে যাওয়ার জন্য যাঁর দিকে একের পর আঙুল উঠছে!
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, সিপিএমের চলতি রাজ্য সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন, বৃহস্পতিবার বুদ্ধবাবু-গৌতমবাবুর সমালোচনায় যাঁরা প্রবল ভাবে সরব, তাঁদের অধিকাংশই দলের প্রাক্তন বা বর্তমান বিধায়ক। এবং এই গোটা সমালোচনার মধ্যেই আরও বেশি নির্দিষ্ট নিশানায় আক্রমণ শানিয়েছেন দুই ২৪ পরগনার পুরনো সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য প্রাক্তন দুই মহিলা বিধায়ক!
দক্ষিণ ২৪ পরগনার প্রাক্তন মহিলা বিধায়ক (যাঁর স্বামী জেলা সিপিএমের ‘দাপুটে’ নেতা এবং মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বুদ্ধবাবুর ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত) আক্ষেপের সুরে বলেছেন, যাদবপুর বিধানসভা কেন্দ্র এলাকায় গত কয়েক মাসে তিনটি কলেজে আক্রমণের ঘটনায় ৭০টা ছেলেমেয়ে আক্রান্ত। ‘কমরেড বুদ্ধদা’ একবার গিয়ে দাঁড়ালেন না সেখানে? প্রশ্ন তুলে তাঁর মন্তব্য, এমন ঘটনা ঘটতে দেখে তাঁদের ‘যন্ত্রণা’ হয়। যাদবপুর এলাকায় ওই নেতা-দম্পতির বিরুদ্ধে সিপিএমের অন্দরেই বহু অভিযোগ আছে। সিপিএম সূত্রের খবর, সম্মেলনের আলোচনায় ওই নেত্রী নিজেই বলেছেন, দুর্নীতির প্রশ্নে তাঁরা কেউই ‘চ্যাম্পিয়ন’ নন। তবুও তাঁর প্রশ্ন ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ গোল যারা বাঁচাতে যায়, তারাই গোল খায়। তাঁদের প্রিয় ‘কমরেড বুদ্ধদা’ এক বার গিয়ে আক্রান্তদের পাশে দাঁড়াবেন না? কমিটির মিটিং ছেড়ে এ বার তো অন্তত উচ্চ নেতৃত্ব রাস্তায় নামুন! |
উত্তর ২৪ পরগনার শিল্পাঞ্চলের প্রাক্তন মহিলা বিধায়কের মত, ধমর্ঘট নিয়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবুর প্রকাশ্য মন্তব্য দলে তাঁদের ‘কষ্ট’ দিয়েছে। পর্যাপ্ত মহিলা নেতৃত্ব তুলে আনতে সিপিএম ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু আলিমুদ্দিনের উদ্দেশে ওই নেত্রীর আরও সরাসরি প্রশ্ন, জেলা থেকেই কেন জেলা সম্পাদক করা
গেল না? রাজ্য নেতৃত্ব কেন তাঁদের জেলার উপরে ‘আস্থা’ রাখতে পারলেন না, বোঝা গেল না! স্পষ্টতই তাঁর ইঙ্গিত গৌতমবাবুর দিকে। প্রসঙ্গত, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতমবাবু উত্তর ২৪ পরগনা জেলারই নেতা হলেও এ বার উত্তর ২৪ পরগনার সম্পাদক পদে তাঁর অভিষেক হয়েছে আলিমুদ্দিনের সরাসরি হস্তক্ষেপে। কিন্তু তাতে যে জেলা কমিটির প্রতিক্রিয়া ‘সন্তোষজনক’ নয়, রাজ্য সম্মেলনে তারই ইঙ্গিত ধরা পড়ল বলে সিপিএম সূত্রের ব্যাখ্যা।
কলকাতার পার্শ্ববর্তী দুই জেলার দুই নেত্রীর সঙ্গেই যোগ করতে হবে বর্ধমানের এক মহিলা প্রতিনিধির কথা। তিনিও সরাসরিই বলেছেন, অনিল বসুর মতোই গৌতমবাবুর নানা মন্তব্য দলের ‘অস্বস্তি’ বাড়িয়েছে। অনিলবাবু অবশ্য এই সম্মেলনে আসেননি। বর্ধমান জেলারই শিল্পাঞ্চলের এক বিধায়ক ও শ্রমিক নেতার চাঁছাছোলা অভিমত, কিছু বলার আগে নেতারা ভেবে নিন, সে কথা প্রমাণ করা যাবে কি না! নইলে দলের কর্মীদের ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ই মানুষের কাছে কমে যায়। এঁদের সকলেরই বক্তব্যের নির্যাস, বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে তৃণমূলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে সব অভিযোগ গৌতমবাবু তুলেছিলেন, তার কিছুই প্রমাণ করতে না-পারায় দলের মুখ পুড়েছে। |
সংগঠনের কাজ যেমন, তেমনই বিগত সরকার পরিচালনার প্রশ্নেও তোপের মুখে বুদ্ধবাবু-গৌতমবাবুরা। নদিয়া জেলার এক প্রাক্তন পুরপ্রধানের মত, বাম জনানায় এক এক জন ২০-২২ বছর করে মন্ত্রী থেকেছেন! এই নীতি অনেক আগেই পর্যালোচনা করা উচিত ছিল। কারণ, এতে জনমানসে বার্তা যায় যে, সিপিএমে ‘পারফরম্যান্সে’র কোনও মূল্যায়ন হয় না। নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণের প্রথম নোটিসের জন্য তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবু দোষ চাপিয়েছিলেন তমলুকের তদানীন্তন সাংসদ লক্ষ্মণ শেঠের উপরে। গোটা নন্দীগ্রাম-পর্বেই সিপিএমের অন্দরে প্রায় ‘খলনায়ক’ হয়ে গিয়েছে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা কমিটি। সেই জেলারই প্রাক্তন এক সভাধিপতি বুদ্ধবাবুদের শুনিয়েছেন, ‘প্রশাসনিক ব্যর্থতা’য় মানুষ তাঁদের উপরে ভরসা হারিয়েছেন। আর সব দোষ গিয়ে পড়েছে কর্মীদের ঘাড়ে!
মুর্শিদাবাদের এক প্রতিনিধি আবার প্রশ্ন তুলেছেন, দিনের পর দিন ‘বুদ্ধদা’ কেন পলিটব্যুরো আর কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে যান না? এখন যেখানেই আক্রমণের ঘটনা ঘটে, সব সময় শুধু বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রই কেন দৌড়ে যান? বাকিরা কেউ কেন বেরোন না? এই সূত্রেই পুরুলিয়া জেলা থেকে এক প্রতিনিধির বক্তব্য, তাঁদের জেলায় রবীন্দ্রনাথ কর (মাওবাদী আক্রমণে) খুন হওয়ার পরে তখনকার রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাস সেখানে ছুটে গিয়েছিলেন। এখন ৬০ জন খুন হয়ে যাওয়ার পরেও নেতাদের খোঁজ নেই! রাঢ় বঙ্গের ওই নেতার আক্ষেপ, সব তারার আলো নেই! যাঁদের নেই, তাঁরা ‘জনগণের নেতা’ নন!
আক্রমণের এই কোরাসে গলা মিলিয়েছেন জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, হুগলি, হাওড়া, কলকাতার অন্য প্রতিনিধিরাও। সিপিএমেরই একাংশের মত, বিগত কয়েকটি রাজ্য সম্মেলনে এত গোলাগুলির সামনে পড়তে হয়নি রাজ্য নেতৃত্বকে।
ক্ষমতাচ্যুত সিপিএমের নিচু তলা এখন প্রায় আগ্নেয়গিরি! |