ইট আর বালির তলায় চাপা পড়েছিল দেহটা। তা সরাতেই দেখা গেল পায়ের অংশ। প্যান্ট দেখে ছেলেকে চিনতে পারলেন বাবা।
এর পরেই জনরোষ। ভাঙচুরের পরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল বাড়িটিতে। গাড়িও জ্বালিয়ে দিল উত্তেজিত জনতা।
অভিযুক্তদের উদ্ধার করতে গিয়ে আক্রান্ত হল পুলিশও। এলাকার নিখোঁজ যুবকের দেহ উদ্ধারের পরে এ ভাবেই বৃহস্পতিবার অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠল বাঁকুড়ার কোতুলপুর এলাকা। পরিস্থিতি সামলাতে নামল র্যাফ ও কমব্যাট ফোর্স। পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে পৌঁছল বিশাল পুলিশ বাহিনী।
|
চৈতক মুখোপাধ্যায় |
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ‘ভ্যালেন্টাইন ডে-র পার্টিতে যাচ্ছি’ বলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন কোতুলপুরের গাঁতি গ্রামের বাসিন্দা চৈতক মুখোপাধ্যায় (২৬)। রাত পর্যন্ত না ফেরায় পরিবারে উদ্বেগ ছড়ায়। বুধবার সকালে কোতুলপুর থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেন চৈতকের বাবা স্বপন মুখোপাধ্যায়। এ দিন সকালে কোতুলপুর সদরের রামকৃষ্ণপল্লি কামারপাড়ায় শ্রীমন্ত দাসের বাড়ির উঠোন থেকে উদ্ধার হয় চৈতকের দেহ। পুলিশ শ্রীমন্ত, তাঁর ভাই তাপস ও মা ঝর্নাদেবীকে গ্রেফতার করেছে। শ্রীমন্তর আর এক ভাই অনুপই দেহ কোথায় পোঁতা আছে, তা জানিয়েছিলেন এলাকাবাসীকে। তবে ঘটনার পর থেকেই তাঁর খোঁজ নেই। পুলিশ সুপার প্রণব কুমার বলেন, “পুলিশই মাটি খুঁড়ে দেহ উদ্ধার করেছে। উত্তেজিত জনতা বাড়িতে ভাঙচুর ও আগুন লাগায়। অনুপের খোঁজ চলছে।”
|
তবে কেন ও কী ভাবে এই খুন, শ্রীমন্তর সঙ্গে চৈতকের সম্পর্ক কীসে-সব ব্যাপারে পুলিশ এখনও ধন্দে। চৈতকের মোটরবাইকটিরও কোনও হদিস মিলছে না। তবে সেই সূত্রেই সমস্ত ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। বুধবার সন্ধ্যায় একটি মোটরবাইকের চাবি খুঁজতে স্থানীয় মোটরবাইক ডিলারের শো-রুমে যান শ্রীমন্ত। কিন্তু ওই ব্যবসায়ী যে সংস্থার মোটরবাইকের ডিলার, শ্রীমন্ত সেই সংস্থার মোটরবাইকের চাবি খোঁজেনি। এতেই প্রথম সন্দেহ হয় ব্যবসায়ীর। তিনি স্বপনবাবুকে সব জানান। এ দিন সকালে স্বপনবাবু এলাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়ে শ্রীমন্তদের বাড়িতে যান।
বাড়িতে গিয়ে শ্রীমন্তদের চেপে ধরেন গ্রামবাসীরা। অনুপ তখনই বলেন, ‘দাদা সব জানে। আমাদের দুই ভাই আর মাকে দাদা নানা ভাবে হেনস্থা করে। মারধরও করে। মায়ের পেনশনের টাকা
কেড়ে নেয়। আপনারা খুঁজে দেখুন, কোথাও চৈতকের দেহ পেয়ে যেতে পারেন’। চৈতকের বোন, একাদশ শ্রেণির ছাত্রী শিল্পার কথায়, “উঠোনে আমগাছের তলায় ইট আর বালির স্তূপ সরাতেই দেখা যায়, পা বেরিয়ে আছে। তখনই বুঝি, ওটা দাদাই!”
এর পরেই স্থানীয় বাসিন্দারা বাড়িতে ভাঙচুর চালান। আসবাবপত্র, দরজা, জানলা ও গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বাধা দিতে গিয়ে ইটের ঘায়ে জখম হন এক কনস্টেবল। কমব্যাট ফোর্সের এক কর্মীরও দাঁত ভাঙে। লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে শ্রীমন্ত, তাপস আর ঝর্নাদেবীকে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। কিন্তু সেখানেও হামলা হতে পারে, এই আশঙ্কায় তিন জনকে নিয়ে যাওয়া হয় সংলগ্ন জয়পুর থানায়। সেখানে তাঁদের জেরা করেন পুলিশ সুপার।
এলাকায় উত্তেজনার পিছনে অন্য কারণও আছে। চৈতকের পাশাপাশিই নিখোঁজ হয়েছেন এলাকারই দাসপল্লির বাসিন্দা, কলেজছাত্র নবীন হালদার। চৈতকের দেহ মেলার পরে চাউর হয়ে যায়, ওখানে নবীনেরও দেহ রয়েছে। নবীনের অবশ্য খোঁজ মেলেনি। |
কোতুলপুর বাজারে স্বপনবাবুর স্টেশনারি দোকান। এক ছেলে, এক মেয়েকে নিয়ে সংসার। স্ত্রী মারা গিয়েছেন। দোকানে বাবাকে সাহায্য করার পাশাপাশি কম্পিউটারের কাজও করতেন চৈতক। এলাকায় ভাল ছেলে হিসাবেই পরিচিতি। এ হেন যুবককে কেন খুন করা হল, বুঝতে পারছেন না কেউ। পড়শিরা বলেন, “ওই তিন ভাইয়ের গতিবিধিই সন্দেহজনক। কেউ সে ভাবে কোনও কাজ করে না। শুধু রাতেই গাড়ি ব্যবহার করত। কিন্তু কোথায় যেত বা কী করত, জানি না। এলাকার কারও সঙ্গেই বিশেষ মেলামেশা করত না শ্রীমন্তদের পরিবার।” স্থানীয় সূত্রের খবর, শ্রীমন্তর বাবা ছিলেন কোতুলপুর ব্লক ভূমি সংস্কার অফিসের কর্মী। গত বছর তিনি মারা যান। শ্রীমন্ত কোনও অসামাজিক চক্রে জড়িত থাকতে পারেন বলে এলাকাবাসীর একাংশের দাবি। কম্পিউটারের কাজের সুবাদে চৈতকের সঙ্গে শ্রীমন্তর পরিচয়। চৈতক কোনও গোপন তথ্য জেনে ফেলায় তাঁকে মারা হল কি না, তা-ও পুলিশ খতিয়ে দেখছে। মঙ্গলবারের ওই পার্টি শ্রীমন্তই দিয়েছিলেন কি না, দেখা হচ্ছে সেটাও। চৈতকের মোবাইলেরও কোনও হদিস মেলেনি। |