পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ-রহস্যের জট খোলা দূরে থাক, উল্টে ঘটনাটি ক্রমশ ঘোরালো হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
পার্ক স্ট্রিটে গাড়িতে তুলে শহরের এক মহিলাকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পরে তাঁর বয়ানের ভিত্তিতে বুধবার রাতে দু’জন যুবককে আটক করে পুলিশ। তাঁদের নাম শরাফত আলি এবং আজহার শেখ। অভিযোগকারিণী তাঁদের শনাক্ত করেন। তবে দু’পক্ষকেই রাতভর জেরার পরে বৃহস্পতিবার পুলিশের দাবি, মহিলার কথায় বেশ কিছু অসঙ্গতি রয়েছে। তদন্ত শেষ হতে এখনও দেরি আছে। গোয়েন্দা-প্রধান দময়ন্তী সেন অবশ্য অভিযোগকারিণী মিথ্যা বলছেন, এ কথা বলতে চাননি। তিনি বলেন, “একটা অভিযোগ পেয়েছি। কিছু একটা ঘটনা অবশ্যই ঘটেছে। সেটা বুঝতেই তদন্ত চলছে।”
লালবাজারের কর্তারা এ কথা জানালেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন মহাকরণে বলেন, “সব আস্তে আস্তে বেরোবে। রাজ্য সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে ঘটনাটি সাজানো হয়েছে।” পরে লালবাজারে কলকাতার পুলিশ কমিশনার রঞ্জিতকুমার পচনন্দাও বলেন, “এই ঘটনা নিয়ে পুলিশ-রাজ্য সরকারকে সমালোচনা করা অনুচিত।” মহিলার বয়ানে অসঙ্গতির দিকগুলি তুলে ধরলেও তিনি অবশ্য আশ্বাস দিয়েছেন, “পুলিশ যথাযথ (ফুল-প্রুফ) তদন্ত করবে। নাগরিকদের কাছে কলকাতা পুলিশ দায়বদ্ধ।” অভিযোগ লেখার সময়ে পার্ক স্ট্রিট থানার পুলিশ মেয়েটির সঙ্গে কোনও দুব্যর্বহার করেছিল কি না, তা-ও খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন লালবাজারের কর্তারা। কলকাতার যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক) সুপ্রতিম সরকারকে এই তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগকারিণী মহিলা অবশ্য নিজের অবস্থানে অনড় রয়েছেন। এ দিনও তিনি বলেন, “ধর্ষণের মানেটা ভুক্তভোগীরাই (পার্সন হু গোজ থ্রু ইট) বোঝেন। আমি এক জন মহিলা। আমার আর কোনও জাত নেই। আমি সুবিচারের জন্যই এত বড় পদক্ষেপ করেছি। এটা দুঃখের যে, এখন আমাকেই সন্দেহ করা হচ্ছে।” এ দিন পুলিশের কাছে আরও একটি অভিযোগ করেছেন ওই মহিলা। তিনি জানিয়েছেন, তাঁকে ফোনে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ফোনে বলা হচ্ছে, টাকা নিয়ে বিষয়টি মিটমাট করে নিতে। পুলিশ জেনেছে, ওই মহিলার ফোনে পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনা থেকে একটি ফোন এসেছিল। এ নিয়েও তদন্ত চলছে।
অভিযোগকারিণীর বয়ান ও পুলিশের হাতে আসা তথ্যপ্রমাণের গরমিল নিয়ে এ দিন দিনভর লালবাজারে তোলপাড় চলে। মহাকরণে সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, পুলিশি তদন্তে আরও কয়েকটি প্রশ্ন উঠছে। সেগুলি হল, মহিলার জীবিকা কী? তিনি ‘এসকট সার্ভিস’-এর সঙ্গে যুক্ত কি না? গোটা ঘটনায় কোনও টাকার লেনদেনের ব্যাপার আছে কি না? মহিলার বাবার নামে পুলিশের খাতায় পুরনো অভিযোগ আছে কি না? গব্বরের মতো কোনও দুষ্কৃতীর সঙ্গে অভিযোগকারিণী ও অভিযুক্তদের যোগ-সাজশ আছে কি না? যদিও ওই মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়েছে কি হয়নি, এর সঙ্গে এ সব প্রশ্নের জবাব খোঁজার কী সম্পর্ক, তা নিয়ে পুলিশের একাংশের মধ্যেই প্রশ্ন উঠছে।
তদন্তের কয়েকটি গরমিলের প্রসঙ্গে অবশ্য অভিযোগকারিণী এ দিন মুখ খুলেছেন। |
• মহিলা দাবি করেছিলেন, লাভি গিদওয়ানি নামে এক যুবকের কথাতেই ওই রাতে পার্ক স্ট্রিটের নাইটক্লাব থেকে বেরিয়ে তাঁর গাড়িতে উঠেছিলেন তিনি। পুলিশি তদন্তে জানা গিয়েছে, লাভি এখন কানাডায়। অভিবাসন দফতরের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ জেনেছে, গত ২ জানুয়ারি কানাডায় পৌঁছন তিনি। লাভি এ দিন কানাডার টরন্টো থেকে স্টার-আনন্দের সঙ্গে কথাও বলেন। তাঁর বক্তব্য, “যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে তখন আমি পরীক্ষার জন্য পড়ছিলাম। আজহার-শরাফতকে চিনি। কিন্তু ওই মহিলার নাম-ধাম কখনও শুনিনি। এই অভিযোগে খুবই খারাপ লাগছে।”
এ বিষয়ে কী বলছেন মহিলা? এ দিন তিনি বলেন, “আমার সঙ্গে নাইটক্লাবে যিনি আলাপ করেছিলেন, তিনি নিজের নাম লাভি গিদওয়ানিই বলেছিলেন। আমি আগে তাঁকে চিনতাম না। পরে ফেসবুকে ‘লাভি গিদওয়ানি’কে খুঁজে পেতে দেখি, দু’জনের ছবি মিলে যাচ্ছে। এর বেশি বলতে পারব না।” তবে লাভির বিরুদ্ধে অভব্য ব্যবহারের কোনও অভিযোগ আগেও করেননি ওই মহিলা, এ দিনও তিনি তা করেননি।
• মহিলার অভিযোগ, ধর্ষণকারীর নাম শরাফত আলি। আজহার আলি এবং লাভিও ওই গাড়িতে ছিলেন। যদিও গোয়েন্দাপ্রধান দময়ন্তী সেনের দাবি, “ওই রাতে অভিযুক্তরা বা মেয়েটি যে এক জায়গায় ছিলেন, তার কোনও নিশ্চিত প্রমাণ এখনও মেলেনি।” পুলিশ সূত্রে বলা হচ্ছে, শরাফত-আজহারের মোবাইলের ‘টাওয়ার লোকেশন’ ঘেঁটে ওই রাতে তাঁদের পার্ক স্ট্রিটের ওই নাইটক্লাবে থাকার প্রমাণ মেলেনি। তবে তাঁরা কাছেই ছিলেন। পুলিশ জেনেছে, কলিন স্ট্রিটে আজহারের বাড়িতে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন শরাফত। সেই অনুষ্ঠানের ভিডিও ছবিও রয়েছে বলে ওই দুই যুবকের দাবি। পুলিশ ওই ভিডিও ফুটেজ খতিয়ে দেখছে। ওই অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে শরাফত ও আজহার পাঁচতারা হোটেলটির উল্টো দিকে রাসেল স্ট্রিটে ধাবায় গিয়ে চা খান। পরে আজহার তাঁর ‘হন্ডা সিভিক’ গাড়ি চালিয়ে শরাফতকে তাঁর খিদিরপুরের বাড়িতে পৌঁছে দেন।
• মহিলার বক্তব্য, হন্ডা গাড়িটায় পাঁচতারা হোটেলের পার্কিং লট থেকে ওঠেন তিনি। কিন্তু পার্কিং লটের সিসিটিভি-তে ওই গাড়িটার অস্তিত্ব ধরা পড়েনি বলে জানাচ্ছে পুলিশ। ওই দুই যুবকের আরও দাবি, যে সময়ের কথা ওই মহিলা তাঁর অভিযোগে লিখেছেন, তখন তাঁরা মোবাইলে ‘চ্যাট’ করছিলেন। পুলিশ বিষয়টি যাচাই করছে। এ বিষয়ে ওই মহিলা বলেন, “মোবাইলের অবস্থানের বিষয়টা শুনে অবাক লাগছে। তবে এটা টেকনিক্যাল ব্যাপার। এ ব্যাপারে আমি কী বলব?”
• মহিলা জানিয়েছিলেন, ঘটনার পরে তিনি রাতে একা ট্যাক্সি করে বেহালায় বাড়ি ফেরেন তিনি। কিন্তু পুলিশ জেনেছে, মহিলার একাধিক বন্ধুর সঙ্গে রাতে ফোনে কথা বলেন। তাঁদেরকেও তিনি সমস্ত ঘটনাটি জানান। পরে তিনি ট্যাক্সি নিয়ে তাঁর এক বন্ধুর বাড়ি যান। সেই বন্ধু ট্যাক্সি করে তাঁকে বেহালার বাড়িতে পৌঁছে দেন। পুলিশ সূত্রের দাবি, মহিলার ওই বন্ধু এক প্রভাবশালী সিপিএম নেতার ছেলে।
• অভিযুক্তদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় নেই বলে ওই মহিলা নাগাড়ে দাবি করলেও এই নিয়েও পুলিশের সন্দেহ রয়েছে। ফেসবুকে ওই তিন যুবক এবং মহিলার এক জন ‘কমন ফ্রেন্ড’ রয়েছেন। অম্বর আলি নামের ওই যুবক আগে লাভিদের কলসেন্টারে কাজ করতেন। কোনও একটা গোলমালের পরে তিনি সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে অভিযোগকারিণীর বোনের কলসেন্টারে যোগ দেন। অভিযোগকারী মহিলা নিজেও আগে ওই কলসেন্টারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে অম্বর আলিকে মহিলার সঙ্গে অভিযুক্তদের ‘যোগসূত্র’ হিসেবে ধরে নিলেও মোবাইলের কল-রেকর্ড ঘেঁটে তাঁর সঙ্গে সাম্প্রতিক কালে ওই তিন যুবকের আলাপচারিতার প্রমাণ মেলেনি। ঘটনার পরে থানায় অভিযোগ লেখা পর্যন্তও অভিযোগকারিণীর সঙ্গে যুবকদের কথাবার্তা হওয়ারও প্রমাণ মেলেনি।
এই সব ধোঁয়াশার মধ্যে তা হলে কীসের ভিত্তিতে তদন্তে এগোচ্ছে পুলিশ? গোয়েন্দাপ্রধানের বক্তব্য, “ঘটনার দিনের পানশালার ভিতরের সিসিটিভি-র ফুটেজ মুছে ফেলা হয়েছে। ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের থেকে খোঁজ নিচ্ছি, সেই ফুটেজ উদ্ধার করা যাবে কি না। এ ছাড়া অভিযুক্ত ও অভিযোগকারিণী সবার বন্ধুদের সঙ্গেই বারবার কথা বলছি।” ওই রাতে গোড়ার দিকে অভিযোগকারিণীর সঙ্গে যে সঙ্গীরা ছিলেন, তাঁদের কয়েক জনের সঙ্গে কথা হয়েছে। সম্ভাব্য প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গেও কথা চলছে।
অভিযোগকারিণী মহিলা ৯ ফেব্রুয়ারি নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জেনারেল ইমার্জেন্সিতে নিজে গিয়ে শুধু ‘শারীরিক নিগ্রহে’র পরীক্ষা করিয়েছিলেন কেন, সেই প্রশ্নও উঠেছে। কেন সেই সময়ে স্ত্রীরোগ বিভাগের চিকিৎসককে দেখানো হয়নি, সে নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন চিকিৎসকেরাও। পুলিশি তদন্তেও বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। |