সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম নিয়ে যতই সমালোচনার মুখে পড়ুক, সিপিএম যে শিল্পায়নের নীতি থেকে সরছে না, রাজ্য সম্মেলন চলাকালীন তা স্পষ্ট করে দিলেন পলিটব্যুরোর সদস্য নিরুপম সেন। বুধবার আলিমুদ্দিনে সাংবাদিক বৈঠকে নিরুপমবাবু বলেন, “রাজ্যে শিল্পায়ন একান্ত জরুরি। শিল্পায়ন না হলে রাজ্য এগোতে পারবে না।” নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে কৃষকদের একাংশের বামেদের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল, তা স্বীকার করেও নিরুপমবাবুর দাবি, “বামফ্রন্টের আমলেই কিন্তু জমি অধিগ্রহণ করে আরও বহু শিল্প হয়েছে। তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। শিল্পায়ন না হলে কর্মসংস্থান হবে না।”
বিধানসভা ভোটে জয়ের সাত মাস পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ঘিরে নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করলেও তৃণমূল নেত্রীর জনপ্রিয়তা যে এখনও অটুট, সেটা বেশ ভালই বুঝতে পারছেন সিপিএম শীর্ষ নেতৃত্ব। বুঝতে পারছেন, এখনই ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা তাঁদের নেই। কিন্তু সেই ‘হতাশার’ মাঝেও আশার একটা ক্ষীণ আলোক বিন্দু দেখতে পাচ্ছেন তাঁরা। সিপিএম নেতাদের মতে, রাজ্যে শিল্পায়ন এবং উন্নয়নের বিষয়কে হাতিয়ার করে অদূর ভবিষ্যতে মমতার সরকারের সামনে একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া সম্ভব। এই সম্ভাবনাকে সামনে রেখেই বিরোধী দল হিসেবে নতুন যাত্রা শুরু করতে চায় সিপিএম। এখনই কিস্তিমাত করার কথা ভাবছেন না বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, নিরুপম সেনরা। তাঁরা আপাতত খেলতে চাইছেন বোড়ে এগিয়ে দিয়ে। |
এ দিন নিরুপমবাবু সেই পথেই শিল্পায়নের প্রসঙ্গ তুলেছেন। জমি অধিগ্রহণ নিয়ে সরকারের নীতিরও সমালোচনা করেছেন তিনি। বস্তুত, সরকারের জমি নীতি ইতিমধ্যেই সমালোচনার মুখে পড়েছে। শিল্পমহলের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গের জমির মালিকানা এত ছোট ভাগে বিভক্ত যে শিল্পায়নের জন্য বড় জমি পেতে গেলে সরকারি হস্তক্ষেপ জরুরি। বর্তমান জমি নীতির ফলে কাটোয়ায় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে শুরু করে বিভিন্ন ইস্পাত কারখানার জন্য জমি পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছে। জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন নিয়েও শিল্পমহলের আপত্তি রয়েছে। তাদের মতে, এই আইনের ফলে একটু বড় জমি কেনাই অসুবিধার। নিরুপমবাবুর কথায়, “শিল্পায়নের ক্ষেত্রে কী হচ্ছে, মানুষ তা দেখছেন। নতুন করে কিছুই বলার নেই। জমি না পেলে নতুন শিল্প আসার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেবেই। আমরা পরাজিত হয়েছি। কিন্তু রাজ্যের স্বার্থে আমরা শিল্পায়ন চাই।”
দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট সম্মেলনের উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেন, বিগত কয়েক বছর ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শিল্পায়ন ও নগরায়নের জন্য বিপুল পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ফলে এ রাজ্যের কৃষকদের মধ্যেও জমি হারানোর আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। বিশেষ করে নন্দীগ্রামের ক্ষেত্রে। কৃষকদের বুঝিয়ে যে ভাবে বিষয়টি দলের পক্ষ থেকে মোকাবিলা করা দরকার ছিল, তা করা হয়নি। আগামী দিনে কৃষকদের বুঝিয়েই শিল্পায়নের জন্য জমি নিতে হবে। নিরুপমবাবু জানান, এই প্রসঙ্গ নিয়ে দু’বছর আগে বিজয়ওয়াড়ার বিশেষ সম্মেলনেও আলোচনা হয়েছিল। দলের অবস্থানের কোনও পরিবর্তন হয়নি। রাজ্যের উন্নয়নের জন্য শিল্পায়ন জরুরি এবং তার জন্য যে জমির প্রয়োজন, তা নিয়েও কোনও বিতর্ক নেই। রাজ্য সম্মেলনে কি এ ব্যাপারে আলোচনা হবে? জবাবে প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী বলেন, “বিষয়টি আলোচনায় আসতে পারে।”
পঞ্চায়েত নির্বাচনের বেশি দেরি নেই। তার আগে এই ভাবে রাজ্য সম্মেলনে শিল্প নিয়ে সিপিএম তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে দিল। নিরুপমবাবু বলেন, “নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুর দুই জায়গাতেই বিরোধীরা শিল্প করতে বাধা দিয়েছে। কিন্তু দু’জায়গার মানুষই তাঁদের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে বাস্তব অবস্থা বুঝতে পারছেন।” সিপিএম কিন্তু এখনই বিষয়টি নিয়ে প্রচারে যেতে নারাজ। নিরুপমবাবুর কথায়, “মানুষ কিছু ভাল পাওয়ার জন্যই পরিবর্তন করে। কিন্তু তাঁদের প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না। অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে মানুষ তা বুঝতে পারছেন। নতুন শিল্প রাজ্যে আসছে না।”
শিল্পায়ন নিয়ে এক দিকে যেমন সরকারের বিরুদ্ধে প্রচার চালানোর পথ নিচ্ছে সিপিএম, অন্য দিকে তেমনই দলকে সংহত ও ‘শুদ্ধ’ করা নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে রাজ্য সম্মেলনে। কারাটও এ দিন ‘অবাঞ্ছিত’দের দূর করে দলকে ‘শুদ্ধ’ করার আবেদন জানান। তবে শুদ্ধকরণ অভিযান নিয়ে জেলা সম্মেলনগুলিতে প্রশ্ন উঠেছে। দলের একাংশের বক্তব্য, কেবল নিচুতলার নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে আঙুল তোলা হচ্ছে। উচ্চ পর্যায় ছাড় পেয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে নিরুপমবাবুকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “নেতৃত্ব ত্রুটি থেকে মুক্ত নয়। কর্মীরাও নয়। উভয় ক্ষেত্রেই কিছু মানুষের ত্রুটি রয়েছে। তা দূর করতে হবে।”
দলের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু জানিয়েছেন, অতীতের ভুল-ত্রুটি থেকে তাঁরা শিক্ষা গ্রহণ করবেন। রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করে বিমানবাবু দলে কিছু নেতা ও কর্মীর অ-কমিউনিস্ট সুলভ আচরণ, জনবিচ্ছিন্নতার কথা তুলে ধরেন। সিপিএমের নেতা-কর্মীদের ভুল-ত্রুটির কথা যে ভাবে বারবার উঠে আসছে, তাতে মনে হচ্ছে, সবই ভুলে ভরা! জবাবে নিরুপমবাবু বলেন, “তা কেন? কিছু কাজে ভুল হয়েছিল। যে মানুষ কাজ করে, তারই ভুল হয়। যে কাজ করে না, তার ভুল হয় না। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার জন্য কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা দিয়েছিল। যা কমিউনিস্টদের কাছ থেকে মানুষ প্রত্যাশা করে না। দল ক্ষমতায় না থাকায় এই ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধনের সুযোগ এসেছে।” বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নিরুপমবাবু বলেন, “মানুষ এখন আমাদের বিরোধী ভূমিকায় দেখছেন। সরকারে থাকার জন্য যে সব অবাঞ্ছিত কার্যকলাপ করার প্রবণতা থাকে, সেই সুযোগ নেই। এই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েই পার্টি শুদ্ধ হবে।” |