আফ্রিকায় প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, চাষযোগ্য জমি আছে। দখলের দৌড়ে
পশ্চিমের চেয়ে এগিয়ে আছে চিন।
এগোচ্ছে ভারত। মায়াকান্না কাঁদছে পশ্চিম।
কোনও সোজা অঙ্ক দিয়ে এই রাজনীতি বোঝা যাবে না। আলোচনা করছেন রংগন চক্রবর্তী |
আফ্রিকা শব্দটার ধারণার মধ্যে সম্প্রতি কেমন যেন একটা সদর্থক ফাটল ধরেছে। আফ্রিকা বলতেই যে একটা জমাট অন্ধকারের ছবির প্রচার চলত, সেটা একটু বদলাচ্ছে। তার একটা কারণ হল, কী করে যেন আলোকপ্রাপ্ত ইয়োরোপের অন্ধকারতম অত্যাচারের ইতিহাস পেরিয়ে, লোলুপ ধনতন্ত্রের সঙ্গে যুদ্ধ করে, এই মহাদেশের নানান দেশগুলো একটু একটু করে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। আফ্রিকার দিকে নতুন করে নজর পড়ার আর একটা কারণ হল, মাত্র পাঁচশো-ছশো বছরেই আমরা দুনিয়ার নানান প্রান্তে প্রাকৃতিক সম্পদ প্রায় শেষ করে এনেছি। তুলনায় ‘অনুন্নত’ বলে আফ্রিকায় সেই সম্পদ এখনও অনেকটাই বেঁচে আছে। আফ্রিকার জমির তুলনায় জনসংখ্যার ঘনত্বও কম, আর যত জমি আছে তার অনেকটাতেই চাষ করা বাকি। এই সব মিলে আফ্রিকা এখন বাকি দুনিয়ার কাছে খুব লোভনীয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে।
আর একটা কাণ্ডও ঘটে গিয়েছে। বেপরোয়া ধনতন্ত্রকে তোল্লাই দিতে গিয়ে পশ্চিমের অনেক রাষ্ট্রেরই এখন দেউলিয়া অবস্থা। নতুন করে আফ্রিকার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো কোমরের জোর এখন কমে এসেছে। উল্টো দিকে, মূলত সস্তা শ্রম, ইচ্ছে মতো কাঁচামাল আহরণের সুযোগ, নানান লাইসেন্স রাজ এবং তৃতীয় বিশ্বের শিল্পপতিদের বাজার জেতার আগ্রহ সম্বল করে চিন, ভারত, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো কিছু দেশ বিশ্ব-বাজারে জায়গা করে নিচ্ছে।
এই পটভূমিকায়, আফ্রিকার নানান দেশে চিন আর ভারতের ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগ নিয়ে নানান রকম আলোচনা উঠে আসছে। সম্প্রতি ইথিয়োপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় চিনের সহায়তায় তৈরি করা আফ্রিকার ইউনিয়নের বিশ তলা বাড়ির উদ্বোধনে হাজির ছিলেন চিনের এই মুহূর্তে তিন নম্বর ক্ষমতাশালী ব্যক্তি জিয়া কুইংলিন। উদ্বোধনী ভাষণে জিয়া ‘ইউরোজোন’-এর ঋণ সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে চিন-আফ্রিকা বন্ধুত্বের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেন। চিন-আফ্রিকা উভয়মুখী বাণিজ্যের মোট পরিমাণ গত দশ বছরে ১০ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ১৬০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। আফ্রিকায় চিনের বিনিয়োগের মূল্য কয়েক মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ১০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। বৃদ্ধির হার আর মোট সংখ্যাগুলো কিন্তু খেয়াল করার মতো বড়। চিন এই মুহূর্তে আফ্রিকার সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অংশীদার। আফ্রিকায় চিনের এই নতুন উৎসাহের আর একটি দিক রয়েছে। আনুমানিক ২০ লক্ষ চিনে নাগরিক ইতিমধ্যেই মোটামুটি স্থায়ী ভাবে আফ্রিকায় বাস করতে শুরু করেছেন। বিভিন্ন দেশে অনুদান, নির্মাণ সহায়তার বিনিময়ে চিন নিজেদের দেশের নাগরিকদের জন্য বসবাস ও কাজের অনুমতি দাবি করছে। লেসোথো ইত্যাদি বহু দেশে এই ভাবে কাজ চলছে। |
বিক্ষোভ পেরিয়ে। সুদানে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে বেজিং-এ ফিরলেন ২৯ জন। |
আফ্রিকায় চিনের এই রমরমা যে পশ্চিম মোটেই ভাল চোখে দেখবে না, তাতে আর আশ্চর্যের কী আছে! গোটা পশ্চিমী মিডিয়া আর তাদের সহযোগী আকাদেমিয়ায় চিনের ‘উপনিবেশবাদী আগ্রাসী নীতি’ নিয়ে হইচই লেগে গিয়েছে। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, চোরের মায়ের বড় গলা। যারা শত শত বছর ধরে খুন করে, ধর্ষণ করে, ক্রীতদাস বানিয়ে, এবং সবচেয়ে বড় কথা, মনুষ্যেতর বলে প্রচার করে আফ্রিকার সর্বনাশ করেছিল, এখন আফ্রিকায় চিন গণতন্ত্র ধ্বংস করবে কি না তাই নিয়ে তাদের কান্নার অন্ত নেই। চিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা নিজের দেশের জনসংখ্যাকে কমানোর জন্য মানুষ চালান করার চেষ্টা করছে, তারা তেলের বদলে কারিগরি বিদ্যা নীতি নিচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার তুলনামূলক ভাবে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকরা বলছেন যে, একটা দেশে যদি সত্যিই মানুষ বেশি হয়, তারা যদি অন্য দেশে গিয়ে কাজ করে খায়, তবে তাতে নিন্দার কী আছে? সে তো ইরাকে বোমা মারতে আমেরিকান সৈন্যর গিয়ে বসে থাকার চেয়ে ভাল। আমাদের অর্থনীতির গোড়ার কথাই তো ছিল প্রয়োজন অনুযায়ী বিনিময়।
আফ্রিকায় কিন্তু ভারতও আগ্রহী। ভারতের বেসরকারি উদ্যোগের বেশ কিছু নামজাদা কোম্পানি আফ্রিকার নানান দেশে ব্যবসা জমিয়ে ফেলেছে। আমাদের পরিচিত নাম টাটা, ভারতী এয়ারটেল ইত্যাদি ছাড়াও নতুন নতুন নামও শোনা যাচ্ছে। ভারতীয় সংস্থারা আফ্রিকার নানান দেশে হাজার হাজার হেক্টর জমি কিনে চাষবাস করতে শুরু করছেন। এদের মধ্যে একটি সংস্থা কারুতুরি গ্লোবাল, ইথিয়োপিয়াতে তিন লক্ষ একর জমি লিজে নিয়ে ফেলে বাণিজ্যিক কৃষি শুরু করতে চলেছেন। গ্লোবাল মিডিয়ায় বলা শুরু হয়েছে যে, আফ্রিকার ওপর চিন আর ভারতের নজর এই দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে কঠোর প্রতিযোগিতা, এমন কী বড়সড় ঝামেলার কারণ হয়ে উঠতে পারে। অর্থাৎ অরুণাচল না হয়ে অ্যাঙ্গোলাও পরবর্তী চিন-ভারত দ্বন্দ্বের ময়দান হতে পারে।
সাধারণ ভাবে আমাদের অনেকের চিন্তার অভ্যাস হল কতকগুলো বড় বড় নীতি বা আদর্শের ছকের ভেতর দিয়ে ভাবা। যেমন আজ আফ্রিকায় আমেরিকা বা চিনের ভূমিকা আমরা কী ভাবে দেখব সেটা নির্ভর করে গত শতকের দুনিয়ার ইতিহাসে এই দুই দেশের এবং বৃহত্তর ভাবে ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক শিবিরের ভূমিকাকে আমরা কী ভাবে দেখেছি তার ওপর। গত শতকের ইতিহাস থেকে যদি শিক্ষা নিই, তবে বোধ হয় বলা যায়, ধনতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক কোনও শিবিরের ওপরেই অন্ধ ভরসা রাখাটা ভুল। দেশের ভেতরে বা বাইরে প্রভুত্বকামী জাতীয়তাবাদ ও রাষ্ট্র-স্বার্থ অতিক্রম করেছে এমন কোনও ধনতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র আজও দেখিনি। সমাজতন্ত্রের উদ্ভবের কালে যদি বা সোভিয়েতের বৈদেশিক সহায়তায় কিছুটা সত্যিকারের সাহায্যের লক্ষণ ছিল, যত দিন গিয়েছিল ততই তার কারিগরি দেউলিয়াপনা, অসততা, সামরিক শক্তির জোরে মাল গছানো, প্রভুত্বকামিতা ইত্যাদি প্রকট হয়ে উঠেছিল। আর, এই সময় জুড়ে তৃতীয় বিশ্বে ধনতন্ত্রের অসম ও আধিপত্যকামী ভূমিকা তো বহু-আলোচিত।
পাশাপাশি, চাই বা না চাই, চিনের আলোচনা আমরা এক ধরনের জাতীয়তাবোধ বাদ দিয়ে করতে পারি না। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে এই শহরের রাস্তায় লেখা হয়েছিল, চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান। তারও আগে আমাদের দাদারা ‘হকিকত’ ছবির চিন-বিরোধী চরিত্রের জন্যে প্রিয়া সিনেমার সামনে বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন। গত চল্লিশ বছরের ইতিহাস বোধ হয় বলে যে, চিনের চেয়ারম্যান মোটেই আমাদের চেয়ারম্যান হতে ব্যগ্র নন (প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতা-বিরোধী আদর্শের দিক থেকে)। বরং মাল্টি-ন্যাশনাল কর্পোরেশনের চেয়ারম্যানশিপ তাঁর কাছে বেশি কাম্য।
তাই বিষয়টা নিয়ে ভাবা সহজ নয়। নানান বিষয় নিয়ে ভাবতে গিয়ে ক্রমশ মনে হচ্ছে, ঠিকঠাক ভাবনার জন্য মন তৈরির আদর্শ বা সামাজিক প্রয়োগের যে কাঠামো দরকার, আমাদের ইতিহাসে আজও সেটা তৈরি হয়নি। তাই আমরা বার বার চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান, নয় চিনের সর্বনাশ আমাদের পৌষমাস জাতীয় অতিসরল, প্রায়শই দ্বিচারিতায় ভরা, ভাবনার মধ্যে ঘুরপাক খাই। আমাদের নানান সমর্থন আর বিরোধিতা তাই সুবিধাবাদিতার বাইরে বেরোতে পারে না। সমাজতান্ত্রিক অনেক লেখায় আমরা ধনতন্ত্র কী করে মনকে বিষিয়ে দেয় তার আলোচনা পাই, কিন্তু সমাজতন্ত্রের যে প্রয়োগ দেখেছি, তাতেও নতুন মানুষ তৈরির গল্প কখন হারিয়ে গিয়েছে।
চিনের আফ্রিকা অভিযান ঘিরে অনেক ঘটনা ঘটছে। দেখা যাচ্ছে যে, চিনের ভেতরে যে ব্যবস্থা চালু আছে, সেই ব্যবস্থাই সে দেশের মানুষেরা তাঁদের নতুন পত্তনে নিয়ে আসছেন। মানুষের অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা মূল ভূখণ্ডেও নেই, তাই সেই মূল্যবোধ নিয়ে আসা কঠিন। পরিবেশ দূষণ বা প্রকৃতি ধ্বংস নিয়েও একই মনোভাব। জাম্বিয়ার তামার খনিতে দু’বছর কাজ করলে তবে মিলবে হেলমেট। দুর্ঘটনা দৈনন্দিন ব্যাপার। ঝামেলা এড়াতে ইউনিয়ন নেতাদের চিনের মাসাজ পার্লারে ‘শিক্ষামূলক ভ্রমণ’-এ নিয়ে যাওয়া হয়। খুব ঝামেলায় পড়লে চিনে মালিকরা নাকি ভাব করেন যে ইংরেজি বুঝতে পারছেন না। আদালতে মামলা উঠলে সাক্ষীদের ভয় দেখানো হয়। দক্ষিণ গাম্বিয়ার সিনাজংগোয়ে শহরে খনি শ্রমিকরা কাজের পরিবেশ নিয়ে বিক্ষোভ দেখালে দু’জন চিনে ম্যানেজার শটগান চালায়।
চিনেরা খুব খারাপ, তাই না? কিন্তু আমাদের কারখানায় আর খনিতে কি অবস্থাটা খুব ভাল? আমরাও কি অনেক উন্নত মূল্যবোধ নিয়ে যাব? মালিকদের দোষ দেওয়া সহজ। কিন্তু ‘সবসে সস্তে আর সবসে অচ্ছে’র বাজারে তো আমরাই লাইন দিই, এর ফলে আমতলায় বা আফ্রিকায় ন্যূনতম মজুরির কী হচ্ছে, ভাবি কি? লক্ষ্মীকান্তপুরের মেয়েটাকে সপ্তাহে এক দিন ছুটি দিতে রাজি? |