এই রাজ্যে শিল্পায়ন হইবে কি না, রাজকোষের হাঁড়ির হাল কখনও বদলাইবে কি না, হাসপাতালে শিশুমৃত্যুর পর সরকারি কুযুক্তির মিছিল কোনও দিন থামিবে কি না, এই প্রশ্নগুলি আসলে বহু দূরের। আপাতত প্রশ্ন: আইনের শাসন কোথায়? এই রাজ্যের রাজধানী কলিকাতায় দিনদুপুরে জনবহুল এলাকায় দুষ্কৃতীরা খুন করিয়া পলাইতেছে, যথেচ্ছ চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই হইতেছে। হাওড়া হইতে বারাসত, চন্দননগর হইতে ভাটপাড়া যে কোনও প্রান্তে যে কোনও কারণে কেহ প্রতিবাদ করিলেই তাঁহার কপালে বেধড়ক মার বাঁধা। সিন্ডিকেটের ছাড়পত্র ছাড়া বাড়ি তৈরির উপায় নাই। কলিকাতার রাস্তায় ট্যাক্সি ধরিবার জন্য নাকি মানুষ ইদানীং মানত করিতেছেন। কলেজে কলেজে অধ্যক্ষ-সংহার চলিতেছে। পশ্চিমবঙ্গবাসী সর্বংসহ, ফলে এই অবস্থাতেও তাঁহারা বিশেষ বিচলিত নহেন। কিন্তু, বঙ্গভূমিতে আজন্ম লালিত নহেন, এমন কেহ এই রাজ্যের অবস্থা দেখিলে সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিতে পারেন পশ্চিমবঙ্গে প্রশাসন নাই? যে রাজ্যে প্রকৃত প্রশাসন থাকে, যে প্রশাসন নিজের দায়িত্ব সম্বন্ধে সম্যক রূপে অবহিত থাকে, সেই রাজ্যের অবস্থা এই রূপ হইতে পারে না। বস্তুত, চেষ্টা করিলে যে অপরাধ দমন করা সম্ভব হয়, তাহার একটি সাম্প্রতিক নিদর্শনও আছে। কলিকাতার মেট্রো রেলে যে ছিনতাইচক্র সক্রিয় হইয়াছিল, রেল পুলিশের তৎপরতায় তাহাকে দমন করা গিয়াছে। প্রশ্ন হইল, ভূগর্ভের তৎপরতা কবে মাটির উপর উঠিবে?
যাহাই ঘটুক না কেন, প্রশাসন নিষ্ক্রিয় হইয়া থাকিবে পশ্চিমবঙ্গে এই সংস্কৃতিটির জন্ম বামফ্রন্টের আমলে। দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নির্বিকল্প প্রয়াসে বামফ্রন্ট প্রশাসনকে নিধিরাম সর্দারের বাড়া করিয়া তুলিয়াছিল। দুঃখের কথা, শাসকের রং বদলাইয়াছে, প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তার ছবিটি বদলায় নাই। যাহারা প্রতিবাদীকে দিনদুপুরে বেধড়ক পিটাইয়া বুক ফুলাইয়া ঘুরিতেছে, তাহাদের গ্রেফতার করা হয় না কেন? যে পুলিশকর্মীরা আদালতের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও শ্বশুরবাড়ি হইতে বিতাড়িত বিধবা যুবতীকে সাহায্য করিতে অস্বীকার করেন (হয়তো বা কোনও স্থানীয় নেতার আজ্ঞা পালনার্থে), তাঁহাদের কঠোরতম শাস্তি হয় না কেন? যে ট্যাক্সিচালকরা অম্লানবদনে যাত্রী প্রত্যাখ্যান করেন, তাঁহাদের লাইসেন্স বাতিল হয় না কেন? দুর্জনে বলিবে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই মূল কারণ আসলে এক অপরাধীদের ধরিয়া থানায় আনিবার খানিক ক্ষণের মধ্যেই অনিবার্য ভাবে টেলিফোন বাজিয়া উঠিবে, এবং অপরাধীদের ছাড়িয়া দিতে হইবে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই যে এই ফোনটি আসে, এমন নয়। কিন্তু কর্তব্য পালন না করিতে করিতে সেই না-করাই পুলিশের অভ্যাস হইয়া গিয়াছে। আশঙ্কা হয়, পুলিশ তাহার দায়িত্ব বিস্মৃত হইয়াছে। সেই দায়িত্বের কথা স্মরণ করাইয়া দিবার কাজটি মুখ্যমন্ত্রীকেই করিতে হইবে। মুখ্যমন্ত্রী কঠোর হউন। পুলিশ সক্রিয় না হইলে পুলিশের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা করুন। নচেৎ, পশ্চিমবঙ্গ যে পথে চলিতেছে, তাহার গন্তব্যে পৌঁছাইতে আর বেশি সময় লাগিবে না। তখন ভারতের অন্য রাজ্যের ছাত্ররা পাঠ্যপুস্তকে পড়িবে, এই দেশে একদা পশ্চিমবঙ্গ নামক একটি রাজ্য ছিল। প্রশাসনহীনতায় আক্রান্ত হইয়া রাজ্যটি একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। |