বারাসত আছে বারাসতেই
দুঃসহ স্মৃতির সরণি বেয়ে যাত্রা রিঙ্কুর
ঠিক এক বছর পর মাঝরাতে সেই ‘বধ্যভূমি’তে পা রাখলেন তিনি। দেখলেন, কার্যত কিছুই পাল্টায়নি। এ দিনও তাঁকে সহ্য করতে হল মত্ত সমাজবিরোধীদের কটূক্তি।
রাত তখন সাড়ে ১১টা। সেই বারাসত স্টেশন। এক বছর আগে কাজ থেকে ফিরে যে স্টেশনে নেমেছিলেন তিনি। সেই উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের রাস্তা। যে রাস্তা দিয়ে ভাই রাজীব তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল সাইকেলে চাপিয়ে। সেই আদালত চত্বর। যেখান থেকে তাঁদের পথ আটকে দাঁড়িয়েছিল তিন নেশাগ্রস্ত যুবক। ভাই-বোনকে ‘ভ্যালেন্টাইন’ ভেবে গায়ে ঢেলে দিয়েছিল মদ। দিদির ‘আব্রু’ রক্ষা করতে গিয়ে একের পর এক ছুরির ঘা খেয়ে লুটিয়ে পড়েছিল মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী রাজীব। ভাইকে বাঁচাতে দিদি ছুটে গিয়ে সাহায্য চেয়েছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের বাংলোয় প্রহরারত পুলিশকর্মীদের। সাহায্য মেলেনি। রাজীবকেও বাঁচানো যায়নি।
সে দিনের পর চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন রাজীবের দিদি রিঙ্কু দাস। বাড়ির বাইরে বের হন না বললেই চলে। ভাই খুনের এক বছরের মাথায় রবিবার রাতে আবার ট্রেন থেকে বারাসত স্টেশনে নামলেন তিনি। ট্রেন থেকে নামার পরে ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম একটু ফাঁকা হতেই রিঙ্কুকে শুনতে হল দুই যুবকের কটূক্তি। এক মত্ত মাঝবয়সী কাছে এসে ঘোলাটে চোখে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন রিঙ্কুকে। সে সময় ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলে ওঠায় কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন তিনি। ‘‘ও-এ যে নায়িকা! ছবি উঠছে।’’ বলে সরে পড়লেন।
আক্রমণ স্থল দেখাচ্ছেন রিঙ্কু। নিজস্ব চিত্র
১ নম্বর প্ল্যাটফর্ম দিয়ে স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে ভ্যান-রিকশা স্ট্যান্ডটিকে দেখিয়ে রিঙ্কু বললেন, “আমাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে সে দিন এখানেই সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ভাই।”
শুরু হল সেই দুঃসহ স্মৃতির সরণি দিয়ে রিঙ্কুর যাত্রা।
সে দিন ছিলেন ভাইয়ের সাইকেলে। এ দিন উঠলেন ভ্যান-রিকশায়। জেলা পরিষদ-আদালত ও জেলাশাসকের অফিসের সামনে তিন মাথা মোড়ে নেতাজির মূর্তি। রিঙ্কু বলেন, “এই সেই জায়গা। এখানেই ওরা আমাদের আটকেছিল। ভাইকে মারছিল।” ভ্যান থেকে নেমে পড়লেন রিঙ্কু। বললেন, “এক বছর আগে এ জায়গাটা ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার। এখন আলো জ্বলছে।”
রাজীব হত্যার পরে রাজ্য জুড়ে শোরগোল ওঠায় জেলা প্রশাসন ওই নির্জন রাস্তায় আলোর ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়েছে। কিন্তু তাতেই কি ফিরে এসেছে নিরাপত্তা?
রিঙ্কু দেখলেন, আলোই সার। জেলা পরিষদ, আদালতের সামনে নেই পুলিশকর্মী। তাই শুনশান ওই রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বার বারই চমকে উঠছিলেন তিনি। পাশের কাছারি ময়দানে ঘন হয়ে জমে রয়েছে অন্ধকার। কিছুটা এগিয়ে গেলেই মদের আড্ডা। রাস্তা দিয়ে ছুটছে মত্ত যুবকদের বেপরোয়া মোটরবাইক। রাজীব হত্যার কয়েক মাস পরেই এ রকম একটি মোটরবাইকে চড়ে ভ্যানরিকশার আরোহী এক মহিলার ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল দুষ্কৃতীরা। বাধা দিতে গিয়ে জখম হয়েছিলেন ওই মহিলা।
জেলা আদালতের সেরেস্তাগুলোয় লাগানো হয়নি আলো। ঝুপসি অন্ধকারে জমে উঠেছে মদের আসর। রিঙ্কু বলেন, “ভাইয়ের খুনের পর খবরের কাগজ পড়ে জেনেছিলাম, এই সব ঝুপড়ি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। আবার সব তৈরি হয়ে গেল!” রিঙ্কুর সঙ্গী মহিলাও বললেন, “সব কিছু একই রকম রয়েছে। ক’দিন আগে নিমন্ত্রণ বাড়ি থেকে ফিরছিলেন এক দম্পতি। নেশাগ্রস্ত যুবকেরা তাঁদের ধরে উত্যক্ত করতে থাকে। নিজেদের পরিচয় দিয়েও পার পাননি তাঁরা। দুষ্কৃতীরা বলতে থাকে, তাঁরা যে স্বামী-স্ত্রী, তার প্রমাণ চাই। অনেক চেঁচামেচির পরে কার্যত হাতে-পায়ে ধরে ছাড়া পান তাঁরা।” এলাকার বাসিন্দারাও জানিয়েছেন, ওই এলাকাতেই ছিনতাই করে পালানোর সময়ে পুলিশকর্মীকে লক্ষ করে গুলি চালানোর ঘটনাও ঘটেছে।
অর্থাৎ বারাসত রয়েছে বারাসতেই!
আদালত চত্বর পার হয়ে এ দিন টহলদারি পুলিশ ভ্যান দেখা গিয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের বাংলোর কাছে। সেখানে এসে রিঙ্কু বলেন, “সে দিন এই বাংলোর গেটটি ধরেও ঝাঁকাচ্ছিলাম। সাহায্য চাইছিলাম পাগলের মতো। কেউ আসেননি।”
এর মধ্যে টহলদারি ভ্যান থেকে নেমে পড়েছেন পুলিশকর্মীরা। এগিয়ে এসে পরিচয় জানতে চাইলেন। তার পর ফের উঠে পড়লেন গাড়িতে। রিঙ্কু বলেন, “যদি সে দিন ছুটে এসে এঁদেরও পেতাম!”
কিন্তু কেন বারাসতের মানুষকে নিরাপত্তার ভরসা দিতে পারছে না পুলিশ প্রশাসন? পুলিশ কর্তাদের ব্যাখ্যা, এত কাণ্ডের পরেও বারাসতে পুলিশকর্মীর সংখ্যা বাড়ানো হয়নি। উল্টে কমে গিয়েছে পুলিশ। তাঁদের হিসেবে, এক বছর আগে শুধু বারাসত এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে ছিলেন ১২৫ জন। এখন সেখানে রয়েছেন মাত্র ৬০ জন পুলিশকর্মী। অর্থাৎ এক বছরের পুলিশকর্মীর সংখ্যা অর্ধেকেরও কম হয়ে গিয়েছে। তাই পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে পুলিশকে।
কিন্তু কেন অর্ধেক হয়ে গেল পুলিশকর্মীর সংখ্যা? জেলার এক পুলিশকর্তা জানান, জেলায় দু-দু’টি কমিশনারেট (বিধাননগর ও ব্যারাকপুর) তৈরি হয়েছে। সেখানেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে পুলিশকর্মীদের একটি বড় অংশকে। কিছু পুলিশ অবসর নিয়েছেন। তাঁদের জায়গায় নতুন কেউ আসেননি। এ ব্যাপারে জেলার পুলিশ সুপার চম্পক ভট্টাচার্য বলেন, “আমি এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করব না।”
তিথি মেনে রাজীবের বাৎসরিক ক্রিয়াকর্ম শেষ হয়েছে দু’দিন আগেই। যারা ধরা পড়েছে তাদের কঠিন সাজার অপেক্ষায় গোটা পরিবার দিন-রাত প্রার্থনা করেছেন। রাজীব হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সিআইডি তিন অপরাধীকে গ্রেফতার করেছিল। মিঠুন দাস নামে মূল অপরাধীকে দমদম সেন্ট্রাল জেলে শনাক্ত করতে গিয়ে তার গালে সজোরে চড় মেরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন রিঙ্কু। অপরাধীদের বিচার চলছে বারাসত আদালতে। ওই মামলায় অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি শান্তময় বসু বলেন, “প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক পদটি শূন্য রয়েছে। তাই বিচার হতে দেরি হচ্ছে।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.