মসজিদে মসজিদে শুরু হয়েছে হারানো মেয়ের সন্ধানে প্রচার। গ্রামে গ্রামে মাইক হাতে ভ্যান রিকশায় ঘুরছেন মা ও বাবা। সকালে বাড়ির উঠোনে খেলতে খেলতে উধাও এক বছরের ছোট্ট জিন্নাতুন খাতুন। ঠিক মতো কথাও ফোটেনি। প্রায় ১২ ঘণ্টা পরে সেই মেয়েকে ফিরিয়ে দিয়ে গেলেন অজানা অচেনা গ্রামবাসীরা। জিন্নাতুনের মা মর্জিনা বিবি মেয়েকে কোলে নিয়ে কেঁদে ফেললেন। বললেন, “এখনও ফরিস্তারা রয়েছেন। এ আমার ও আমার মেয়ের নতুন জন্ম হল।” মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জের লবনচোয়া গ্রাম লাগোয়া চাঁদপুরে সারা দিনের উৎকণ্ঠা কেটে তখন খুশির তুফান।
বাড়ির সামনেই রোজ খেলে জিন্নাতুন। তার তেমন কোল বাছাবাছি নেই। সারা গ্রামই যেন তার পরিবার। ফুটফুটে সেই শিশুকন্যাকে ভালবাসেন গ্রামের মানুষও। উঠোনে তাকে খেলতে দেখলে কেউ একটু দাঁড়িয়ে তাকে আদর করে যায়। মর্জিনা বিবি বলেন, “কখনও কখনও কারও সাইকেলে চড়ে ঘুরে আসে গ্রাম। আমরা তেমন কোনও চিন্তাও করি না। কিন্তু রবিবার হঠাৎই দেখি মেয়ে নেই।” গ্রামের বাড়ি বাড়ি খোঁজ শুরু হল। তারপরে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম। কোথাও হদিস মিলল না। এরপরেই সাড়া পড়ে যায় গ্রামে। মসজিদের মাইকে প্রচার শুরু হয়ে যায়। ভ্যানরিকশায় চেপে মেয়েকে খুঁজতে বেরোন মর্জিনা বিবি ও তাঁর স্বামী বিড়ির ঠিকাদার জিয়াউর রহমান। কিন্তু বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়, মেয়ের হদিস মেলে না। |
তখনই চাঁদপুরের প্রায় ৩০-৩৫ কিলোমিটার দূরে গঙ্গাপ্রসাদ গ্রামের কুলগাছিতে সন্ধ্যার আঁধারে এক মহিলার দিকে নজর পড়ল গ্রামবাসীদের। গ্রামের মোরাম পথ ধরে চলেছেন সেই মহিলা। কোলে একটি ফুটফুটে শিশু। কিন্তু সে তারস্বরে কাঁদছে। গ্রামের স্কুলের শিক্ষক মহম্মদ সারোয়ার হোসেন বলেন, “মায়ের কোলে কোনও বাচ্চা এমন ভাবে কাঁদে না। অবাক হয়ে গিয়ে গ্রামবাসীরাই ঘিরে ধরেন ওই মহিলাকে। তারপরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গিয়ে দেখা গেল সে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছে।” ওই মহিলাকে গ্রামের একটি বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখা হয়। সারোয়ার বলেন, “মাত্র কয়েকদিন আগে আমাদের গ্রাম থেকেও হারিয়ে গিয়েছে এক বছর বারোর কিশোর। তার খোঁজ মেলেনি। গ্রামের মানুষের সন্দেহ হয়, ওই মহিলাও ওই শিশুটিকে চুরি করে এনেছেন।”
চাঁদপুরের পাশাপাশি আরও ১৫টি গ্রামের মসজিদে মসজিদেও তখন শুরু হয়ে গিয়েছে প্রচার। গোটা এলাকাটাই তাই জানাজানি হয়ে গিয়েছে রবিবারের সন্ধ্যা-রাতে যে, হারিয়ে গিয়েছে ছোট্ট জিন্নাতুন।
গঙ্গাপ্রসাদে তখনই গ্রামের মহিলাদের জেরায় জেরায় ওই মহিলা বলেছেন, চাঁদপুরের কথা। চাঁদপুরের পাশের গ্রামের এক ব্যক্তিকে তখন ফোন করেন শিক্ষক মহম্মদ সারোয়ার। সেই ব্যক্তি চলে যান চাঁদপুরে। তিনিই ফোনে জানান জিন্নাতুনের পরিচয়। সারোয়ার বলেন, “রাত তখন প্রায় সাড়ে ন’টা।”
ইতিমধ্যে পুলিশও জেনে গিয়েছে সব কথা। গঙ্গাপ্রসাদের গ্রামবাসীরা জিন্নাতুন ও ওই মহিলাকে নিয়ে চলে আসেন জঙ্গিপুর হাসপাতালে। সেখানেই চলে আসেন মর্জিনা বিবিরাও। মেয়েকে কোলে পান তিনি।
মর্জিনা বিবি বলেন, “যে মহিলা আমার মেয়েকে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন, তিনি আমারই পিসিমা। মেয়েকে খুব ভালওবাসেন। কিন্তু তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন। মেয়েকে কোলে নিয়ে প্রায়ই ঘুরতেন। কিন্তু তিনি পথ ভুলে এত দূর চলে যাবেন, তা বুঝতেই পারিনি কেউ।”
সেই মহিলা কেসনুর খাতুনেরও কান্না থামে না। তিনি বলেন, “আমাকে খুঁজে পেয়ে গঙ্গাপ্রসাদের লোকজনেরা বাঁচিয়ে দিয়েছেন।” |