নয়াদিল্লি আর জর্জিয়ার তিবলিসি। সোমবার সন্ত্রাসের নিশানায় দুই শহরের ইজরায়েল দূতাবাসের কর্মীরা। জর্জিয়ায় বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয় করা গেলেও বিস্ফোরণ এড়ানো গেল না নয়াদিল্লিতে। নজিরবিহীন ভাবে স্বাধীনতার ৬৫ বছরের ইতিহাসে প্রথম বার রাজধানীর বুকে আক্রান্ত হলেন কোনও বিদেশি দূতাবাসের কর্মী। ২০০২-এ কলকাতায় মার্কিন দূতাবাসে হানার পর এই প্রথম ভারতে কোনও দূতাবাসকর্মী আক্রান্ত হলেন। তা-ও একেবারে রাজধানীর বুকে খোদ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ৭ রেসকোর্স রোডের ঢিলছোড়া দূরত্বে। |
সোমবার ইজরায়েলি দূতাবাসকর্মীর গাড়িতে বিস্ফোরণের এই ঘটনায় গুরুতর আহত হলেন দূতাবাসের মুখ্য নিরাপত্তা অফিসারের স্ত্রী তালি যোশুয়া কারেন-সহ চার জন। কারেন নিজেও কূটনীতিক। বিস্ফোরণের কারণ বা ষড়যন্ত্রকারীদের বিষয়ে রাত পর্যন্ত ধোঁয়াশা কাটেনি। দিল্লি পুলিশ জানিয়েছে, ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের থেকে রিপোর্ট পাওয়ার পরেই বিস্ফোরণ নিয়ে বিস্তারিত জানানো সম্ভব হবে। ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানইয়াহু অবশ্য সরাসরি ইরানের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন। তাঁর দাবি, ইরানই বিশ্বে সন্ত্রাস ছড়ানোর অন্যতম মুখ্য কারিগর। তাদের মদতে পুষ্ট জঙ্গিগোষ্ঠী হিজবুল্লাই সোমবার দুই শহরে বিস্ফোরণের ছক করেছিল। ইজরায়েলের অভিযোগ, এর আগেও আজেরবাইজান, তাইল্যান্ড-সহ একাধিক দেশে ইজরায়েলের দূতাবাসে হামলার ছক করেছিল ইরান।
বিদেশমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণের সঙ্গে ফোনে কথা বলার পর ইজরায়েলের বিদেশমন্ত্রী আভিগডোর লিবেরম্যান কড়া ভাষায় ইরানের নিন্দা করে জানিয়েছেন, হামাস এবং হিজবুল্লার মতো ইজরায়েল-বিরোধী বিভিন্ন গোষ্ঠীকে দীর্ঘদিন ধরে মদত দিচ্ছে তেহরান। সোমবারের ঘটনার পিছনেও কারা রয়েছে তা তাঁরা জানেন। আপাতত বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। যথাসময়ে এই বিস্ফোরণ নিয়ে সব তথ্য জানাবে ইজরায়েল সরকার। তবে ঘটনার পিছনে যারাই যুক্ত থাকুক না কেন, তাদের যথোপযুক্ত ‘শাস্তি’ দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন তিনি। ইজরায়েলি নিরাপত্তা সংস্থা সিন বেটের তরফে জানানো হয়েছে, সম্প্রতি তুরস্কের আকাশে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইজরায়েলের একটি বিমান নামানোর পরিকল্পনা করেছিল তেহরান। তাদের কাছে খবর ছিল, ২০০৮-এর ফেব্রুয়ারিতে দামাস্কাসে নিহত কম্যান্ডারের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিশ্বজুড়ে ইজরায়েলের দূতাবাসে হামলা চালাতে পারে হিজবুল্লা। সেই মতো বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার জন্যই এ দিন জর্জিয়ায় বিস্ফোরণ এড়ানো গিয়েছে।
ইরান অবশ্য এ দিন হামলা চালানোর সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তেহরান জানিয়েছে, তাদের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে ইজরায়েলের আপত্তির কথা সর্বজনবিদিত। ইরানের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করতেই ইজরায়েল সরকার নিজেদের লোকের উপরে হামলা চালিয়েছে। তার পর দায় চাপিয়েছে ইরানের ঘাড়ে। ভারতে ইরানি রাষ্ট্রদূত মাহদি নাবিজাদেও জানিয়েছেন, তাঁর দেশ যে কোনও রকম ‘সন্ত্রাসবাদী’ হামলারই বিরুদ্ধে। |
এ দিন ঠিক কী হয়েছিল নয়াদিল্লিতে?
প্রত্যক্ষদর্শীকে উদ্ধৃত করে দিল্লির পুলিশ কমিশনার বি কে গুপ্ত জানান, এ দিন সওয়া তিনটে নাগাদ অওরঙ্গজেব রোডের ইজরায়েল দূতাবাস থেকে ‘১০৯ সিডি ৩৫’ নম্বরের একটি ইনোভা গাড়িতে করে মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে বেরিয়েছিলেন ওই কূটনীতিক কারেন। তাঁদের গাড়ি যখন অওরঙ্গজেব রোড ও সফদরজঙ্গ রোডের মোড়ের ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে ছিল, তখন সন্দেহভাজন দুই ব্যক্তি মোটরবাইকে করে এসে গাড়িটির পিছনে কিছু লাগিয়ে দ্রুতগতিতে বেরিয়ে যায়। এর পরেই জোরালো বিস্ফোরণ ঘটে ও গাড়িটিতে আগুন ধরে যায়। বিস্ফোরণের তীব্রতায় ইনোভার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য একটি গাড়িতেও আগুন ধরে যায়। পথচলতি মানুষই আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠান। কারেনের গাড়ির চালক মনোজ শর্মার অবশ্য দাবি, কারেনকে একটি অটোয় চাপিয়ে তিনি তড়িঘড়ি দূতাবাসে ফেরেন। সেখান থেকে তাঁকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। বাকি তিন জনের অবস্থা স্থিতিশীল হলেও জানা গিয়েছে কারেনের পেটে স্প্লিন্টারের জখম গুরুতর। দু’টি অস্ত্রোপচারের পর তাঁকে আইসিইউ-তে রাখা হয়েছে। অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
ইজরায়েল দূতাবাসের কর্মীকে আক্রমণের নিশানা করা হলেও নয়াদিল্লিতে যেখানে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে, প্রশ্ন উঠে গিয়েছে তা নিয়েই। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন-সহ একাধিক দেশের দূতাবাস রয়েছে ওই অঞ্চলে। এ রকম সুরক্ষিত একটি এলাকায় নিরাপত্তার বেষ্টনী এড়িয়ে গাড়িতে বিস্ফোরক লাগিয়ে কী ভাবে দুষ্কৃতীরা পালিয়ে যেতে পারল, তার সদুত্তর দিতে পারেননি দিল্লি প্রশাসনের কর্তারা। এমনকী বিস্ফোরণ যেখানে হয়েছে, তার অল্প দূরেই রয়েছে তুঘলক রোড থানা। তা সত্ত্বেও কেন বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের দায়িত্বে থাকা এসপিজি অফিসারদের থেকে তাদের ঘটনার কথা জানতে হল, মেলেনি তার উত্তরও। রাজধানীর ওই রকম ‘হাই-সিকিওরিটি জোন’-এর মধ্যে যদি বিদেশি কোনও জঙ্গিগোষ্ঠী এত সহজে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চলে যেতে পারে, তবে সামগ্রিক ভাবে দেশের রাজধানী কতটা সুরক্ষিত তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা। দিল্লি হাইকোর্টে গত বছর সেপ্টেম্বরে হামলা বা ২০০১-এ সংসদে জঙ্গি হামলার থেকে শিক্ষা নিয়ে রাজধানীর নিরাপত্তা তা হলে কতটাই বা আঁটোসাঁটো করা হয়েছে?
প্রশ্ন রয়েছে বিস্ফোরণের প্রকৃতি নিয়েও। জর্জিয়ায় ইজরায়েলি দূতাবাস কর্মীর গাড়ির নীচে যে ধরনের বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে, সেই ধরনের ‘প্লাস্টিক বিস্ফোরক’ই নয়াদিল্লিতেও ব্যবহার করা হয়েছে বলে প্রাথমিক ভাবে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিস্ফোরণ ঘটাতে যে ধরনের উন্নত ‘রিমোট কন্ট্রোল’ ডিভাইস বা ‘টাইমার’ ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে এর পিছনে বিদেশি কোনও শক্তির হাত থাকার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা।
|