শেষ পর্যন্ত পোস্তা গেলেন খোদ পুলিশ কমিশনার। গেলেন এমন দিনে, যখন শহরের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে রাজ্যপাল বললেন, তিনি পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে কথা বলবেন।
শহরে একের পর এক অপরাধের ঘটনার কিনারা করতে পারছে না পুলিশ এই অভিযোগ ক্রমেই বাড়ছে। ব্যবসায়ী মহল থেকে বিরোধী শিবিরসকলের কথাতেই সমালোচনার সুর। এই পটভূমিতে সোমবার সকালে একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে রাজ্যপালের মন্তব্য: “এ ব্যাপারে পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে কথা বলব।”
ঘটনাচক্রে, প্রায় একই সময়ে সরেজমিনে পরিস্থিতি দেখতে বড়বাজার-পোস্তার পথে ঘুরলেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার রঞ্জিতকুমার পচনন্দা। পর পর দু’দিন, প্রথমে কলাকার স্ট্রিটে প্রকাশ্য রাজপথে লুঠের মতলবে এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে খুন এবং পরের দিন হরিরাম গোয়েন্কা স্ট্রিটে ছুটির সকালে কচুরি খেতে আসা দম্পতিকে ছুরি মেরে ছিনতাইয়ের পরে ওই তল্লাটে গিয়েছিলেন সিপি। যেমন ঠিক এক দিন আগে কসবা তথা দক্ষিণ শহরতলির পরিস্থিতি নিয়ে থানার ওসিদের সঙ্গে তাঁকে বৈঠকে বসতে হয়েছে। সাবেক কলকাতা না কলকাতা পুলিশের সংযুক্ত এলাকা কোনটা ছেড়ে কোনটা সামলাবেন, এই টানাপোড়েনে এখন এতটাই দিশাহারা লালবাজারের কর্তারা। |
এই পরিস্থিতিতে স্বভাবতই সুর চড়াচ্ছে বিরোধী দলগুলি। এ দিন দুপুরে স্থানীয় কাউন্সিলর মীনাদেবী পুরোহিতের নেতৃত্বে বড়বাজার থানা ঘেরাও করে বিজেপি। আর নতুন সরকারের জমানায় স্রেফ গত দু’মাসে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ঘটনাবলীর উল্লেখ করে সিপিএম বিধায়ক তথা রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের অভিযোগ, “সাধারণ ভাবে আইন-শৃঙ্খলার দ্রুত অবনতি হচ্ছে।” পুলিশ দফতর যে হেতু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে রয়েছে, তাই তাঁকেই নিশানা করছেন সূর্যবাবুরা। বিরোধী দলনেতার কথায়, “এ সব ঘটনা প্রমাণ করছে মুখ্যমন্ত্রী যে দফতরের দায়িত্বে, তার হাল কী।
মুখ্যমন্ত্রী কোনওটারই সমাধান করতে পারেননি। বরং, জটিলতা বেড়েছে।” ব্যবসায়ী সংগঠনের কর্তা মহেশ সিংহানিয়াও বলেন, “প্রশাসনের উপরে ভরসা কমে যাচ্ছে। বিশেষত ওই এলাকার মহিলা ও শিশুরা অত্যন্ত আতঙ্কিত বোধ করছেন।”
শাসক দল অবশ্য কোনও অভিযোগেই আমল দিতে রাজি নয়। তাই প্রকাশ্যে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। তবে তৃণমূলের এক শীর্ষনেতা বলেন, “৩৪ বছর ধরে যারা রাজ্যে শ্মশানের রাজত্ব কায়েম করেছিল, বানতলা থেকে নন্দীগ্রাম একের পর এক ঘটনায় যে সরকার কলঙ্কিত হয়েছে, তাদের মুখে সমালোচনা সাজে না। বরং মানুষ কেন তাঁদের ত্যাগ করলেন, তা বুঝে অনুশোচনা করুন।’’
শাসক দল আইন-শৃঙ্খলার অবনতির অভিযোগ মানতে না চাইলেও পুলিশ-প্রশাসন কিন্তু ঠেকায় পড়ে নড়েচড়ে বসেছে। পুলিশ কমিশনার এ দিন বলেন, “পোস্তা ও বড়বাজার থানার মাঝামাঝি কোনও জায়গায় একটি আউটপোস্ট তৈরি হবে। যত দিন না নতুন আউটপোস্ট তৈরি হচ্ছে, তত দিন দু’টি কিয়স্ক বসানো হবে।” বড়বাজার-পোস্তায় পুলিশি টহলদারির খামতি দূর করতে ইতিমধ্যে একটি টহলদার গাড়ি (রেডিও ফ্লাইং স্কোয়াড) ওই তল্লাটে নিয়ে আসা হয়েছে। লালবাজারের এক কর্তার কথায়, “রাস্তায় পুলিশ বেশি দেখা গেলে দুষ্কৃতীরা কিছুটা চাপে থাকবে।”
অনেকটা একই ভাবে কসবার কথা ভেবেও ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন বাইপাসে পুলিশি টহলদারি বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। পুরো এলাকায় গাড়িতে নজরদারিও বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু রাস্তায় পুলিশের দৃশ্যমানতা বাড়ানোর এই কৌশল আদপে কতটা কাজে আসবে, সে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।
সাবেক অথবা সংযোজিত এলাকা পর্যাপ্ত পুলিশকর্মীর অভাবে সর্বত্রই রণকৌশল ঠিক করতে লালবাজারের কর্তারা কার্যত হিমশিম খাচ্ছেন। বস্তুত, দুষ্কৃতী-তাণ্ডবের রমরমার পিছনে পুলিশের এই ‘লোকাভাব’ই একটি প্রধান কারণ বলে ঠারেঠোরে মানছেন তাঁরা। গত পয়লা সেপ্টেম্বর থেকে দক্ষিণ শহরতলির বিস্তীর্ণ এলাকা কলকাতা পুলিশের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরে গোয়েন্দা বিভাগের ‘সোর্স নেটওয়ার্ক’ তৈরি ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে আশানুরূপ ‘অগ্রগতি’ হয়নি বলেই ধারণা একাংশের। শুধু তাই-ই নয়, কলকাতা পুলিশের সাবেক এলাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন থানা থেকেও পোড়খাওয়া পুলিশকর্মীদের অনেককে সংযোজিত এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ফলে পুরনো এলাকায় দুষ্কৃতীদের গতিবিধির উপরে নজর রাখার কাজ প্রায়শই ধাক্কা খাচ্ছে। মানে এক দিকের পরিস্থিতি সামলাতে গিয়ে প্রায়শই শহরের অন্য প্রান্তে সমস্যা ঘোরালো হচ্ছে।
বড়বাজার-পোস্তার মতো এলাকাগুলিতে নজরদারি ফের ঢেলে সাজার পাশাপাশি লালবাজারের কর্তারা সংযুক্ত এলাকায় গোয়েন্দা বিভাগের সোর্স-নেটওয়ার্কে খামতি দূর করার চেষ্টায় ব্যস্ত। পুলিশ কমিশনারের দাবি, “দক্ষিণ শহরতলির জন্য গোয়েন্দা বিভাগের অধীনে দু’টি পৃথক দল কাজ শুরু করেছে।”
তবে পুলিশকর্তাদের মতে, এ যাত্রা একটি বড় সমস্যা হল এখনও পর্যন্ত অপরাধের পিছনে সংগঠিত-চক্রের অস্তিত্ব খুঁঁজে না পাওয়া। এক গোয়েন্দা-অফিসারের কথায়, “অনেক ক্ষেত্রেই ছোটখাটো পকেটমার-ছিনতাইবাজরাই মারাত্মক ঘটনা ঘটিয়ে ফেলছে।
কোনও কোনও দুষ্কর্মে মাদকাসক্তরাও জড়িত বলে জানা যাচ্ছে। ছিনতাই-লুঠের মাল বিক্রি করে নেশা করার টানে মাদকসেবীরাও মাঝেমধ্যে হিংস্র হয়ে উঠছে।” |