|
|
|
|
চোখ খোলাল পানিহাটি |
শিশুমৃত্যু রোধের হাতিয়ার দেরাজে, জানেন না কর্তারা |
সোমা মুখোপাধ্যায় ও বিতান ভট্টাচার্য • কলকাতা |
বই রয়েছে। কিন্তু সে সব আলমারিতে তালা মারা! সিডি-ও রয়েছে বিস্তর। তবে তার অধিকাংশই চালানো হয় না! ফলে অকেজো হয়ে গিয়েছে।
রাজ্যে সরকারি হাসপাতালে শিশুমৃত্যু নিয়ে শোরগোলের অন্ত নেই। শিশুমৃত্যু ঠেকানোর লক্ষ্যে আলাপ-আলোচনা, এবং মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নিত্যনতুন পরিকল্পনা-কর্মসূচিও প্রচুর। অথচ যে ব্যবস্থাগুলো আগে থেকেই রয়েছে, সেগুলো ঠিকঠাক কাজে লাগানো হচ্ছে কি না, এ বার সেই প্রশ্ন উঠে গেল। যেমন, বছর কয়েক আগে মা ও সদ্যোজাতের পরিচর্যা ও চিকিৎসা সংক্রান্ত একটি সহজপাঠ্য বই এবং একটি তথ্যচিত্র তৈরি হয়েছিল সরকারি খরচে। কথা ছিল, রাজ্যের সব সরকারি হাসপাতাল-স্বাস্থ্যকেন্দ্রের লেবার রুমে নিযুক্ত নার্সদের বইটা বিলি করা হবে। আমজনতাকে দেখানো হবে তথ্যচিত্রটি, যার বিষয়: সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও কী ভাবে প্রসূতি ও সদ্যোজাতের পরিচর্যা সম্ভব। জন্মের পরে পরে বাচ্চ্রার যে সব সমস্যা দেখা দেয়, ‘নবজাতক শিশু-সুরক্ষা কর্মসূচি’র অঙ্গ হিসেবে প্রস্তুত ওই বই ও তথ্যচিত্রে সেগুলো মোকাবিলার খুঁটিনাটি উপায় বলা রয়েছে। |
|
পানিহাটি হাসপাতালে তথ্যচিত্রটির প্রদর্শনী। ছবি: বিতান ভট্টাচার্য। |
কিন্তু ঘটনা হল, শিশুমৃত্যুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এমন উপযোগী দু’টি অস্ত্রের অস্তিত্বের কথাই জানেন না অধিকাংশ স্বাস্থ্য-কর্তা। ফলে পরের পর শিশুমৃত্যুর ঘটনায় তামাম পশ্চিমবঙ্গ যখন তোলপাড়, তখনও ওই সব বই ও তথ্যচিত্রের সিডি তালাবন্দি হয়ে পড়ে রয়েছে বিভিন্ন হাসপাতালে। এগুলোর ‘অস্তিত্ব’ সামনে এল কী ভাবে? সম্প্রতি পানিহাটি হাসপাতালে স্থানীয় উদ্যোগে তথ্যচিত্রটির প্রদর্শনীর পরে ব্যাপারটা নজরে এসেছে। ওখানকার আউটডোরে প্রতি মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার প্রসূতিদের নানান পরামর্শ দেওয়া হয়। সেই মতো গত সপ্তাহে গর্ভবতী মহিলা ও তাঁদের পরিজনের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেওয়ার পরে তথ্যচিত্রটিও দেখানোর ব্যবস্থা করেছিলেন হাসপাতালের সুপার মলয় দাস এবং অন্য চিকিৎসকেরা। বাইশ মিনিটের ছবিটি হাসপাতালের সমস্ত নার্স ও অনুব্রতীকেও দেখানো হয়। এবং দর্শকদের মধ্যে এর প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক। কী বলছেন তাঁরা?
আসন্নপ্রসবা সন্ধ্যা রায় এসেছিলেন শাশুড়ি রাধাদেবীর সঙ্গে। পরিচারিকার কাজ করেন রাধাদেবী। বৌমার হাত ধরে তিনি বলেন, ‘‘ভাল খাবার বা দামি ওষুধ কিনে দেওয়ার সাধ্য কোথায়? কিন্তু সরকারের ঘরেই যখন আমাদের শেখানোর এত সুন্দর বন্দোবস্ত আছে, কে জানত? জানি না, এটা এত দিন তালাবন্ধ হয়ে ছিল কেন। যা দেখলাম, তাতে আমাদের গরিবের ঘরেও মা আর বাচ্চার যত্ন নেওয়া সম্ভব হবে।” দু’টি সন্তানের মৃত্যুর পরে তৃতীয় বার অন্তঃস্বত্ত্বা হয়েছেন মালা সরকার। তাঁর কথায়, “এমন যে আছে, জানতামই না! সব হাসপাতালে এটা দেখানো উচিত। তা হলে এত মা আর বাচ্চা মারা যাবে না।’’
এমনকী, পানিহাটি হাসপাতালের নার্সরাও স্বীকার করেছেন, তথ্যচিত্রটি দেখে এমন অনেক তথ্য তাঁরা জেনেছেন, যা আগে জানতেন না। ওই দিন তথ্যচিত্র প্রদর্শনের সময়ে ব্যারাকপুরের তথ্য-সংস্কৃতি আধিকারিক শান্তনু চক্রবর্তী নিজেও পানিহাটি হাসপাতালে হাজির ছিলেন। তিনি জানাচ্ছেন, ‘‘স্বাস্থ্য দফতরের জন্যই সরকারি টাকায় এই ধরনের বিভিন্ন তথ্যচিত্র তৈরি হয়েছিল। অথচ ২০০৭ সাল থেকে সেগুলো এত দিন এক কোণে তালাবন্ধ হয়ে পড়েছিল। এখন খুঁজে-পেতে বার করা হয়েছে। সব ক’টা সিডি ঠিকমতো চলছেও না।”
প্রকল্পটির এ হেন দুরবস্থা কেন?
স্বাস্থ্য-কর্তাদের বক্তব্য, জেলায় জেলায় প্রকল্পটির দায়িত্বে রয়েছেন উপ মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক-৩। কিন্তু শিশুমৃত্যু প্রতিরোধে জন-সচেতনতা বৃদ্ধির কাজের যথাযথ প্রশিক্ষণ তাঁদের অনেকেরই নেই। তাই তাঁরা অন্যদেরও শেখাতে পারছেন না। বই-সিডিও পড়ে থাকছে। পুরুলিয়া জেলা স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা বলেন, “আমি নতুন এসেছি। আমার আগে যিনি ছিলেন, তিনি বিষয়টি জানতেন। এ দিকে আমার এখনও এ সবের ট্রেনিং হয়নি।” মালদহের এক স্বাস্থ্য-অফিসারের মন্তব্য, “এক বার নার্সদের ডেকে ফিল্মটা দেখিয়েছিলাম। তার পরে দেখলাম, কারও কোনও আগ্রহ নেই। তাই ও সব আর ভাবি না।”
ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে উদ্যোগটা কাগজে-কলমে থমকে রয়েছে। এটাই কি ভবিতব্য?
জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের রাজ্য অধিকর্তা দিলীপ ঘোষ বলেন, “ব্যাচ অনুযায়ী প্রশিক্ষণ হয়। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে আমরা চেষ্টা করছি সমস্ত স্তরে দ্রুত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে। অবশ্য ট্রেনিং নেওয়ার পরেই সংশ্লিষ্ট কর্মীর বদলি হয়ে গেলে সমস্যা দেখা দেয়। যে কারণে ভাবা হচ্ছে, সচেতনতা সম্প্রসারণের বিষয়টা নার্সিং পাঠ্যক্রমে ঢোকানো যায় কি না।” তবে উদ্যোগটি হাতে-কলমে প্রয়োগের দায়িত্ব যাঁদের হাতে রয়েছে, তাঁরা আগ্রহী না-হলে সাফল্য মিলবে কি? কর্তারা নড়েচড়ে বসলেও শেষ পর্যন্ত এই প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। |
|
|
|
|
|