আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের সামনেই এ বার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভারত সরকারের কাছে তিস্তা চুক্তি নিয়ে আর্জি জানালেন বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী দীপু মণি। তাঁর আমন্ত্রণে বিদেশ মন্ত্রকে আজ উপস্থিত হয়েছিলেন মৈত্রী-সফরে বাংলাদেশে আসা সাংবাদিকদের একটি আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি দল। ভারত ছাড়াও জাপান, তাইল্যান্ড, নেপাল ও জর্ডনের সাংবাদিকরা ছিলেন সেই দলে। তাঁদের সামনেই বিদেশমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এ বিষয়ে যে ভাবে উদ্যোগী হয়েছেন, দিল্লি তা ঢাকাকে নিয়মিত অবহিত করছে। তিস্তা চুক্তি নিয়ে তিনি আশাবাদী।
আজ নিজের দফতরে দীপু মণি বলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ায় দারুণ খুশি হয়েছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেছিলেন, ও পার বাংলাতেও আর এক জন মহিলা সরকারের প্রধান নির্বাচিত হওয়ায় তিনি আনন্দিত। কিন্তু বাংলাদেশের প্রত্যেকে চাইছেন, তিস্তার জলবণ্টন নিয়ে ভারতের সঙ্গে স্পষ্ট একটি চুক্তি হোক। বাংলাদেশ তিস্তার জলের ন্যায্য ভাগ পাক। বিদেশমন্ত্রী বলেন, তিনি আশা করেন, ভারত সরকার ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষের হতাশার বিষয়টি বুঝবেন।
মনমোহন সিংহের ঢাকা সফরের সময়েই তিস্তার জলবণ্টন নিয়ে দু’দেশের চুক্তি সইয়ের কথা ছিল। কিন্তু জলের ভাগ নিয়ে মমতার আপত্তিতে তা ভেস্তে যায়। বাংলাদেশও ভারতকে ট্রানজিটের সুযোগ দেওয়া থেকে পিছিয়ে যায়। বিদেশমন্ত্রী বলেন, ট্রানজিট না পাওয়ায় ভারতের ক্ষোভের বিষয়টি তিনি বোঝেন। এর সঙ্গে তিস্তা চুক্তির কোনও সম্পর্ক রয়েছে বলেও তিনি মনে করেন না। তবে এটাও মানেন, তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়িত হলে ট্রানজিট-সহ অন্য বিষয়গুলি নিয়ে দু’দেশের মতভেদও হয়ত মিটে যেত।
এর আগে ভারতে একটি সফরে গিয়ে কলকাতায় মহাকরণে মমতার সঙ্গে দেখা করে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী। সরকারি ভাবে সেই সফরকে নেহাতই সৌজন্যমূলক বলে প্রচার করা হয়েছিল। কিন্তু আসলে তিস্তা চুক্তি নিয়ে আপত্তি প্রত্যাহারের আর্জিই সে দিন মমতাকে জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী। তবে মমতার জবাবে কিছুটা ধৈর্যচ্যুতিই হয়েছিল তাঁর। মমতা তাঁকে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, “আপনাদের দাবি মতো জল দিতে পারব, এমন প্রতিশ্রুতি দিতে পারছি না।” ক্ষুব্ধ দীপু মণি বলে গিয়েছিলেন, “তিস্তা যেমন আপনাদের, তেমন আমাদেরও। এ কথা কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না।” এ দিন অবশ্য বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী সেই বৈঠকের প্রসঙ্গ তোলেননি। বরং তাঁর গলায় ছিল আবেদনেরই সুর।
এক দিকে তিস্তা চুক্তি, অন্য দিকে ট্রানজিট। এই দুই বিষয় নিয়ে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কে একটি টানাপোড়েন চলছেই। আবার চায়ের দোকানের আড্ডা থেকে ঢাকার সচিবালয়, বাংলাদেশের সর্বত্রই কিন্তু মমতার গুরুত্ব যেন ভীষণ ভাবে বেড়ে গিয়েছে। তিস্তা চুক্তি না হওয়ার জন্য কয়েক মাস আগেও সাধারণ মানুষ দুষেছেন মমতাকে। কিন্তু এখন দোষারোপের নিশানায় খোদ মনমোহন সিংহের সরকার। মানুষের এই মনোভাবকে পুঁজি করেই সরকার-বিরোধিতার আঁচকে উস্কে তুলতে নেমেছে বিরোধী বিএনপি ও তার সঙ্গী জামাতে ইসলামি। কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামি লিগের সম্পর্ক ঐতিহাসিক ভাবেই যতটা ঘনিষ্ঠ, তৃণমূলের সঙ্গে ততটা নয়। এই বিষয়টি বুঝে বিএনপি-ও নতুন কৌশল নিয়েছে। তারা তৃণমূলের সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক তৈরিতে সচেষ্ট হয়েছে। হাসিনার দলের কাছে সে খবরও এসে পৌঁছেছে। বছর দুয়েক পরেই ভোট বাংলাদেশে। এর মধ্যে তিস্তা চুক্তি করা না গেলে তারা যে বড়সড় বিপাকে পড়বে, আওয়ামি লিগ তা বিলক্ষণ বোঝে। সেই জন্যই তারা আরও অধৈর্য হয়ে উঠেছে।
ট্রানজিট ও বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে ঢাকার সঙ্গে কথা বলতে এসেছে ভারতের একটি প্রতিনিধি দলও। আজ একপ্রস্ত আলোচনা হয়েছে, হবে কালও। কিন্তু ‘ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রিটি অ্যান্ড ট্রেড প্রোটোকল’-এর মেয়াদ নিয়ে আজ বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়ে ভারত ও বাংলাদেশ। ভারত এই প্রোটোকলের মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে বাড়িয়ে দশ বছর করার প্রস্তাব দিলেও ঢাকা তাতে রাজি নয়। তাদের কথা, ২০১২-র মার্চে প্রোটোকলটির মেয়াদ ফুরোলে ফের তা সংশোধন করা হতে পারে। তার পরে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কিন্তু যুগ্মসচিব এম কে জহুরি তাঁদের বোঝান। বলেন, বাংলাদেশকে সাহায্যের জন্য ভারত শুধু ১০০ কোটি ডলারের ঋণ সাহায্য ঘোষণা করেই বসে থাকেনি, বাংলাদেশের পাঠানো বিভিন্ন প্রকল্পে ৭৫ কোটি ডলার মঞ্জুরও করে দিয়েছে। নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে ট্রানজিটের সুবিধাও বাংলাদেশকে দিয়েছে। ঢাকা যে ৬৪টি পণ্যে শুল্কছাড় চেয়েছিল, তার সবগুলিই দিল্লি মেনে নিয়েছে। রেল যোগাযোগ আধুনিকিকরণে এগিয়ে এসেছে। এমনকী উত্তর-পূর্ব ভারতে বিদ্যুৎ প্রকল্পে লগ্নি করার আমন্ত্রণও জানানো হয়েছে ঢাকাকে। তা হলে, বাংলাদেশের পক্ষে এমন অনাস্থা প্রদর্শন কেন? ভারতীয় প্রতিনিধিরা অবশ্য আশা করছেন, আগামী কালের বৈঠকেই এই মতভেদ কাটিয়ে ওঠা যাবে।
কিন্তু, এই অনাস্থা কেন? তিস্তা চুক্তি না হওয়া নিয়ে ঢাকার হতাশাই একমাত্র না হলেও যে প্রধান কারণ, সে বিষয়ে কারও সন্দেহ নেই। অনাস্থা কাটাতে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়কে ঢাকা সফরে আমন্ত্রণ জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। ঢাকা মনে করছে, প্রণবের সফরে দু’দেশের সম্পর্কের টানাপোড়েন অনেকটাই কাটতে পারে। কিন্তু তিস্তা চুক্তি না হওয়াটাই যে এখন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে প্রধান কাঁটা, মনমোহনও বিষয়টি বুঝেছেন। চুক্তি যাতে দ্রুত হয়, সে জন্য মমতাকে বোঝাতে উদ্যোগী হয়েছেন তিনি। বিদেশসচিবকে কলকাতায় পাঠাচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে। দীপু মণিও সেই কারণেই আশাবাদী। এখন তাঁরা মমতার দিকেই তাকিয়ে। |