রাতের অন্ধকারে টানা দশ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে খড়ের পালুই, দোকান পুড়িয়ে দিল দুষ্কৃতীরা। কালনা ১ ও ২ ব্লকে শুক্রবার রাতের ঘটনা। কিন্তু কী কারণে এই অগ্নিকাণ্ড এবং কারা ওই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত, রবিবার পর্যন্ত তার কোনও কিনারা করতে পারেনি পুলিশ। এক পুলিশ আধিকারিকের কথায়, “রহস্যজনক ঘটনা। জট খোলার চেষ্টা চলছে।” তবে ঘটনা নিয়ে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে রাজনৈতিক চাপানউতোর।
কালনা ১ ব্লকের সুলতানপুর পঞ্চায়েতের ভাটরা, বেলেডাঙা এবং কালনা ২ ব্লকের অকালপৌষ পঞ্চায়েতের তেহাট্টা, বাজিতপুর, আগ্রাদহ, পাঁচরখি, ঘোষপুরের মতো গ্রামগুলির অবস্থান পাশাপাশি। বাসিন্দাদের অধিকাংশেরই জীবিকা চাষাবাদ। আমন মরসুমে ধান ঝাড়ার পরে প্রতি বারের মতো এ বারও বাড়ির কাছে পালুই তৈরি করে রেখে দিয়েছিলেন তাঁরা। গবাদি পশুর খাবারের জন্য রেখে প্রয়োজন মতো সেখান থেকেই বছরের বিভিন্ন সময়ে তাঁরা খড় বিক্রি করেন। শনিবার ভোরে গ্রামবাসীরা ঘুম থেকে উঠে দেখেন, রাস্তার গা ঘেঁষে থাকা খড়ের পালুই থেকে আগুন আর ধোঁয়া বেরোচ্ছে। দ্রুত তাঁরা কাছাকাছি পুকুর থেকে মেশিনের মাধ্যমে জল তুলে আগুন নেভান। আগুন নেভাতে মসজিদের মাইকে গ্রামবাসীদের জড়ো করা হয় বাজিতপুরে। |
প্রতিটি গ্রামেই গ্রামবাসীরা প্রথমে ভেবেছিলেন, এই অগ্নিকাণ্ড তাঁদের গ্রামেরই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু পরে এলাকার মানুষের মুখে মুখে খবর পৌঁছে যায়, অগ্নিকাণ্ড হয়েছে ভাটরা গ্রাম থেকে পাঁচরখি পর্যন্ত প্রায় দশ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে।
সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তেহাট্টা গ্রাম। গ্রামের পাঁচটি জায়গায় আগুন লেগেছিল। এর মধ্যে তিনটি বড় খড়ের পালুই, একটি দোকানঘর এবং একটি বিয়েবাড়ির মণ্ডপ। গ্রামের পশ্চিমপাড়ায় রাস্তার পাশে বাড়ি আদিত্য ঘোষ এবং জয়দেব ঘোষ নামে দুই ভাইয়ের। বাড়ির কাছেই ছিল তাঁদের খড়ের পালুই। তাঁদের এক আত্মীয় দিব্যেন্দু ঘোষ আগুন নেভানোর কাজ করতে করতেই বললেন, “ভোরে মাঠে যাওয়ার জন্য বেরিয়েছি। দেখি, ওদের খড়ের পালা দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে। তাড়াতাড়ি সবাইকে ডেকে আগুন নেভানো শুরু করেছি।” বিষ্ণুপদ কর্মকার, বাদল মণ্ডলের খড়ের পালুইও পুড়েছে। গ্রামের মাঝামাঝি জায়গায় উদয় গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ি। মেয়ের বিয়ের জন্য সেখানে মণ্ডপ বাঁধা হয়েছিল। বৌভাতের অনুষ্ঠান সেড়ে শুক্রবার রাত দু’টো নাগাদ বাড়ি ফেরেন তাঁরা। এর ঘণ্টা খানেক পরেই তাঁরা দেখেন, আগুন ধরে গিয়েছে বিয়ের মণ্ডপে। পুড়ে গিয়েছে গ্রামের শেষ প্রান্তে খড়ের ছাউনি দেওয়া লীলা সাঁতরার চায়ের দোকান-ও। |
বাজিতপুর গ্রামে আব্দুল লতিফ মণ্ডল এবং আব্দুল রহিম মণ্ডলের দু’টি বড় খড়ের পালুই ছিল। এই দু’টিতে রাখা ৬০ কাহন ধানই পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। দুই চাষির কথায়, “আমাদের তো কোনও শত্রু নেই। ধান বিক্রি করে এ বার লাভজনক দাম পাইনি। ভেবেছিলাম, বাজার চড়লে খড় বিক্রি করে দাম পাব। সে তো আর কপালে নেই।” এ ভাবেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছেন আগ্রদহ গ্রামের সমসের আলি, পাঁচরখি গ্রামের নারায়ণ চক্রবর্তীরা। এলাকা ঘুরে দেখা গিয়েছে, বেশিরভাগ জায়গাতেই অগ্নি সংযোগ করা হয়েছে রাস্তা থেকে ফুট দশেক দূরত্বের মধ্যে। প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশের অনুমান, ঘটনার সঙ্গে একাধিক দুষ্কৃতী জড়িত।
এই ঘটনায় লেগে গিয়েছে রাজনীতির রঙ। তৃণমূলের অভিযোগ যথারীতি সিপিএমের বিরুদ্ধে। কালনা ২ ব্লক তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি প্রণব রায়ের অভিযোগ, “সিপিএম পরিকল্পিত ভাবে হিংসা ছড়ানোর চেষ্টা করছে। আমরা পুলিশের কাছে তদন্ত চেয়েছি।” অন্য দিকে, সিপিএমের কালনা জোনাল কমিটি অবশ্য এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। এত বড় এলাকা জুড়ে না হলেও কালনা ২ ব্লকে এ ঘটনা অবশ্য নতুন নয়। মাস চারেক আগেই ছোট বহরকুলি, পাথরঘাটা, চা-গ্রাম এলাকার ছ’টি জায়গায় ধানের গাদা ও খড়ের পালুইতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল কেউ। বছর দেড়েক আগে বৈদ্যপুর গ্রামেও একই ঘটনা ঘটে। পুলিশ অবশ্য কোনও ঘটনারই কিনারা করতে পারেনি।
|
ছবি: কেদারনাথ ভট্টাচার্য। |