দার্জিলিং পাহাড়ের জন্য জিটিএ চুক্তি রূপায়ণ ‘ত্বরান্বিত’ করতে এ বার খোদ প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ হচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ইতিমধ্যেই মমতা প্রধানমন্ত্রীর দফতরে ফোন করে ওই বিষয়ে কেন্দ্রের ‘দীর্ঘসূত্রতা’র জন্য তাঁর ‘ক্ষোভ’ জানিয়েছেন। শনিবার উত্তরবঙ্গ ছাড়ার কিছু আগে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের ফাঁকেই তিনি সরাসরি প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করেন। বৈঠকের অব্যবহিত পরেই প্রধানমন্ত্রীর দফতরের তরফে কলকাতায় মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়কে জানানো হয়, আগামী ২২ ফেব্রুয়ারি, বুধবার বিকেলে মমতাকে সময় দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
স্বভাবতই, মমতা উচ্ছ্বসিত।
এবং তিনি আরও উচ্ছ্বসিত (আসলে আশ্বস্ত) মোর্চা নেতারা তাঁর সঙ্গে ‘একমত’ হওয়ায় যে রাজ্য নয়, কেন্দ্রই চুক্তি রূপায়ণে ‘টালবাহানা’ করছে। অর্থাৎ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে জিটিএ চুক্তি রূপায়ণ নিয়ে তাঁর ‘সদিচ্ছা’র অভাব নেই। এ দিনের বৈঠকের পর এটাও স্পষ্ট যে, মোর্চা নেতৃত্ব এবং রাজ্য উভয়ের তরফেই অভিযোগের ‘কাঠগড়া’য় কেন্দ্র। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে ফিরে তিনি আবার দার্জিলিং যাবেন ২৮ ফেব্রুয়ারি। সেই সফরে মমতা যেতে চান সান্দাকফুতেও। তাঁর আগামী দার্জিলিং-সফর যে পাহাড়ের মানুষকে রাজ্য সরকারের ‘ইতিবাচক’ মনোভাব বোঝাতে, ঘনিষ্ঠমহলে তা-ও জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর আস্থাভাজন এক নেতার কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী নিজে গিয়ে মানুষকে পরিস্থিতি বোঝালে তাঁরা বুঝবেন। উনি গেলে প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক স্তরেও একটা নাড়াচাড়া তৈরি হবে।” |
ঘটনাচক্রে, মোর্চার তরফে জিটিএ চুক্তি রূপায়ণের চূড়ান্ত সময়সীমা দেওয়া হয়েছে ২৭ মার্চ। মমতা চান, তার অন্তত এক মাস আগেই বিষয়টির ‘ইতিবাচক নিষ্পত্তি’ করতে।
মুখ্যমন্ত্রী এ দিন স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, পাহাড়ে কোনও অশান্তি বরদাস্ত করা হবে না। তাঁর কথায়, “যে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হয়েছে, সেই অনুযায়ী আমরা কাজ করব। এর মধ্যে আর কাউকে নাক গলাতে দেওয়া হবে না। রাজ্য সরকার সেটা বরদাস্ত করবে না।” মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, “দু’একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী এদের (মোর্চা নেতৃত্ব) বিরুদ্ধে বলছে। কিন্তু তাদের সঙ্গে কোনও মানুষ নেই। একটি রাজনৈতিক দল তাদের মদত দেওয়ার চেষ্টা করছে।” প্রশাসনিক মহলের অভিমত, নাম না-করে মমতা ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বলতে ছত্রে সুব্বা এবং ‘রাজনৈতিক দল’ বলতে সিপিএমকেই বুঝিয়েছেন। মমতার কথায়, “আমি বলছি, দার্জিলিং শান্ত আছে। তাকে শান্তই থাকতে দিন। আমরা পাহাড়-তরাই-ডুয়ার্স নিয়ে ঢালাও উন্নয়ন করছি। সেই উন্নয়নের গতি রোধ করার চেষ্টা করবেন না। আগুন নিয়ে খেলবেন না!”
এক দিকে যেমন দু’একজন ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং রাজনৈতিক দল’কে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী, তেমনই এ দিন প্রকাশ্যেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জিটিএ চুক্তি নিয়ে কেন্দ্রের ভূমিকায়।
মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠমহল এই বিলম্বে ‘কংগ্রেসের হাত’ই দেখতে পাচ্ছে। এমনিতেই দুই শরিকের সম্পর্ক এখন যথেষ্ট টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ঘনিষ্ঠ মহলে মমতা-সহ তৃণমূলের একাধিক নেতা কংগ্রেস সম্পর্কে খুব ‘উদার’ মন্তব্য করছেন না। এক শীর্ষনেতা যেমন সম্প্রতি বলেছেন, “ওরা (কংগ্রেস) চেষ্টা করলেও এখানে আমাদের সরকারকে ফেলতে পারবে না। কিন্তু আমরা চাইলে ওদের সরকারকে খেয়ে ফেলতে পারি!” এর মধ্যেই এসে পড়েছে জিটিএ-বিতর্ক। দলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, “অতীত বলছে, দার্জিলিংয়ের জন্য ষষ্ঠ তফসিল গঠন করেও বিষয়টিকে টালবাহানা করে প্রায় দু’বছর ঝুলিয়ে রেখেছিল কংগ্রেস। ফলে পাহাড়ে আবার অশান্তি ছড়িয়ে পড়ে। এ বারেও তার ছায়া দেখা যাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। নইলে এত দেরির তো আর কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না!”
মুখ্যমন্ত্রী নিজে অবশ্য ‘আশাবাদী’ যে, প্রধানমন্ত্রী তাঁর সঙ্গে দেখা করার পর ‘ইতিবাচক ব্যবস্থা’ই নেবেন। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “আমি দার্জিলিং এবং আরও কয়েকটি বিষয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলব।” যা থেকে প্রশাসনিক মহলের একাংশ মনে করছে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতে মমতা পাহাড় ছাড়াও রাজ্যকে কেন্দ্রীয় সাহায্য দেওয়া নিয়ে শুরু-হওয়া সাম্প্রতিক ‘তরজা’ নিয়েও কথা বলবেন এবং রাজ্যের জন্য বরাদ্দ দাবি করবেন।
এ দিন সকালে মোর্চা নেতা রোশন গিরি, অমল রাই, পাহাড়ের দুই বিধায়ক হরকা বাহাদুর ছেত্রী এবং তিলক দেওয়ানের সঙ্গে (বিমল গুরুঙ্গ আসেননি) প্রায় আধ ঘণ্টা বৈঠক করেন মমতা। তাঁর সঙ্গে ছিলেন দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী এবং মুকুল রায়। ছিলেন দার্জিলিংয়ের জেলাশাসক এবং পুলিশ সুপারও। বৈঠক থেকেই মমতা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ২৩ বা ২৪ তারিখ দেখা করতে চেয়ে আবেদন জানান। |
বৈঠকের পর মোর্চা নেতাদের পাশে নিয়েই মমতা বলেন, “কেন্দ্রীয় সরকার যে ভাবে জিটিএ চুক্তি রূপায়ণ করতে দেরি করছে, তাতে ওঁরা (মোর্চা নেতারা) অসন্তুষ্ট। আমিও ওঁদের সঙ্গে একমত। কেন্দ্রীয় সরকার দেরি করছে। বেশ দেরি করছে।” মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “ওরা (কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক) আবার চুক্তির কিছু বিষয় জানতে চেয়েছে। তার জবাব আমরা দিয়েও দেব। আশা করব, তার পর আর ব্যাপারটা নিয়ে অনর্থক দেরি করা হবে না।”
বৈঠকের পর রোশন বলেন, “আমাদের ক্ষোভ একটাই জিটিএ চুক্তি রূপায়ণে কেন দেরি হচ্ছে? সেটাই মুখ্যমন্ত্রীকে বলেছি।” পাশাপাশি অবশ্য রোশন জানান, তাঁরা ২৭ মার্চের সময়সীমা বহালই রাখছেন। তার মধ্যে চুক্তি রূপায়িত না-হলে তাঁরা প্রকাশ্যেই জিটিএ চুক্তির প্রতিলিপি পোড়াবেন।
প্রশাসনিক সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে রোশনরা বিশেষত দার্জিলিং শহরের উন্নয়নের দাবিও করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের সেই ‘আশ্বাস’ও দিয়েছেন। পরে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “জিটিএ চুক্তি রূপায়িত না-হলে কেন্দ্রীয় সরকারের টাকাটাও তো আটকে থাকছে! অথচ, দার্জিলিং শহরের হাল ফেরাতে অবিলম্বে অর্থ প্রয়োজন। এর আগের সফরে এসে আমি তৃণমূলের রাজ্যসভা সাংসদদের এলাকা উন্নয়ন তহবিলের থেকে কিছু অর্থ বরাদ্দ করে গিয়েছিলাম। কিন্তু তা অবশ্যই যথেষ্ট নয়।” মোর্চার তরফে ২৭ মার্চের ‘চূড়ান্ত সময়সীমা’ বহাল রাখার বিষয়টি গুরুঙ্গদের গোর্খাল্যান্ড নিয়ে ‘অনড়’ থাকা বলেই ব্যাখ্যা করতে চাইছে একটি মহল। তবে প্রশাসনের পদস্থ অফিসারদের মতে, আপাতত এটা বলা ছাড়া গুরুঙ্গদের উপায়ও নেই। কারণ, তাঁদেরও রাজ্য এবং কেন্দ্রের উপর ‘পাল্টা চাপ’ বজায় রাখতে হবে। রাজ্য প্রশাসনের এক পদস্থ অফিসারের কথায়, “ওঁরা বাঘের পিঠে চড়েছেন। আলাদা গোর্খাল্যান্ড যে হবে না, সেটাও ওঁরা জানেন। কিন্তু তার বদলে উন্নয়ন না-করতে পারলে পাহাড়ের মানুষও ওঁদের ছেড়ে দেবেন না! ফলে ওঁদের পাল্টা চাপের রাস্তায় থাকতেই হবে।”
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে দেখা করতে চেয়ে যে রাস্তায় হাঁটছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতাও। |