পাতলা সুতির পোশাক ছাড়া কিছুই পরানো যায় না বছর ছয়েকের মেয়েটিকে। এমনকী, শীতকালে উলের পোশাকও নয়। পরালেই সারা গা চুলকোতে শুরু করে। ঘা হয়ে যায়। মা-বাবা ব্যাপারটা স্কুল কর্তৃপক্ষকে বোঝাতেই পারেননি। স্কুলের একটাই কথা তাঁদের বাচ্চাকে ইউনিফর্মে কোনও ‘ছাড়’ দেওয়া যাবে না।
মা-বাবা শেষমেশ চিকিৎসকের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। ডাক্তার ডিজ্ঞাসা করেন, বাচ্চার অল্পেই হাঁচি-কাশি হয় কি? হাঁপানির কোনও উপসর্গ আছে?
দেখা গেল, ঠিক তা-ই। দু’টোই রয়েছে।
মা-বাবা তখন জানতে পারলেন, তাঁদের মেয়ে ‘অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিস’-এ আক্রান্ত। রোগটি মূলত শৈশবেই দেখা দেয়। এবং চিকিৎসকদের বক্তব্য, গত দশ বছরে এ দেশে তা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। জিনগত কারণ ছাড়াও মানসিক চাপ ও শৈশবে পর্যাপ্ত স্তন্যপান না-করার ফলেও রোগটি দেখা দিতে পারে বলে চিকিৎসকদের অনুমান। সচেতনতা কম থাকায় চিকিৎসাও শুরু হয় দেরিতে। যার নিট ফল, শিশুদের ভোগান্তি। সম্প্রতি অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিস নিয়ে বিশ্ব জুড়ে চিকিৎসক মহলে আলোচনা শুরু হয়েছে। তৈরি হয়েছে ‘এশিয়া প্যাসিফিক অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিস বোডর্।’ যাদের কাজ, চিকিৎসার নির্দেশিকা তৈরি করা। চলতি মাসে ফিলিপিন্সের ম্যানিলায় বসবে বোর্ডের প্রথম বৈঠক।
বোর্ডের সদস্য, চর্ম চিকিৎসক সন্দীপন ধর জানাচ্ছেন, এই রোগে আক্রান্ত শিশুদের ত্বক অতিরিক্ত সংবেদনশীল হয়। সামান্য কিছু কামড়ালেই ঘা, নানান খাবারে অ্যালার্জি। ধুলোর সংস্পর্শেও সমস্যা। এমনকী, ফুলের গন্ধে বা পোষা প্রাণীর গায়ে হাত দিলেও অ্যালার্জি হয়ে যেতে পারে। সন্দীপনবাবুর কথায়, “সাধারণত ৬ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে রোগের প্রকোপ থাকে।
প্রথমে একজিমা, তার পরে ঘন ঘন হাঁচি-কাশি, শেষে হাঁপানি। তিনটিকে একত্রে বলা হয় ‘অ্যাটোপিক ট্রায়াড।’ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ১৬ বছরের পরে অসুখটা সরে যায়।”
|
অ্যাটোপিক অ্যালার্জি হলে |
সব সময়ে সুতির পোশাক |
বাড়িতে পোষা প্রাণী রাখা বিপদ |
গাছপালায় বেশি হাত নয় |
ত্বক শুকনো হলে মুশকিল |
সুগন্ধীসাবান, ক্রিম চলবে না |
কাপড়ে কড়া ডিটারজেন্ট নয় |
|
চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, বিভিন্ন স্কুল থেকেও এই ধরনের সমস্যা তাঁদের কাছে রেফার করা হচ্ছে। দক্ষিণ কলকাতার এক স্কুলের শিক্ষিকা তপতী ধর বলেন, “আমার ক্লাসেই অন্তত চার জনের ঘন ঘন অ্যালার্জি হতো। সামান্য ধুলো উড়লেই প্রবল কাশি। চোখ লাল হয়ে যেত। খাবারের অল্প এ-দিক ও-দিক হলেই হাতে-পায়ে চুলকানি। ব্যাপারটা জটিল বুঝে ওদের ডাক্তারের কাছে পাঠানো হয়েছিল। তার আগে রোগটার নামই জানতাম না।”
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, রক্তে আইজিই নামে একটি অ্যান্টিবডি বেশি থাকলে এই অ্যালার্জির প্রবণতা তৈরি হয়। ডার্মাটোলজিস্ট সঞ্জয় ঘোষের বক্তব্য, যে সব পরিবারে শিশুরা খুবই পরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকে, তাদের অনেকের এই সমস্যা দেখা দেয়। কী ভাবে?
সঞ্জয়বাবু বলেন, “খুব যত্নে থাকার কিছু উল্টো ফল রয়েছে। এ তেমনই। পরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকায় ব্যাকটেরিয়াজনিত অসুখের সংখ্যা কমেছে। এ দিকে অ্যান্টিবডির কাজ জীবাণু বা ছত্রাক ধ্বংস করা। সেই কাজের চাপ না-থাকায় তারা নিজেদের দেহের বিরুদ্ধেই লড়াই শুরু করে।” তা ছাড়া পরিবারে কারও অ্যাটোপিক অ্যালার্জি থাকলে সদ্যোজাতেরও হতে পারে। চিকিৎসকদের মতে, জন্মের দিন কয়েকের মধ্যে বাচ্চার হাত-পায়ে লালচে দাগ দেখলে অবিলম্বে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। উপরন্তু অ্যাটোপিক অ্যালার্জিতে আক্রান্ত শিশুর খাওয়া-দাওয়া কিংবা পোশাক-আশাক নিয়ে অভিভাবকদের বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা না-করাই শ্রেয়। ডাক্তারেরা আরও জানাচ্ছেন, শৈশবে চিকিৎসা শুরু না-হলে পরে রোগটি শরীরে শক্তপোক্ত শিকড় তৈরি করে। তখন হাঁপানি সারাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়।
অ্যাটোপিক অ্যালার্জির চিকিৎসা কী?
বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, সাধারণ অ্যালার্জির যে চিকিৎসা, এ ক্ষেত্রেও সাধারণত তা-ই। সংক্রমণ হলে অ্যান্টিবায়োটিকও প্রয়োজন হতে পারে।
তবে মূল বার্তা একটাই শৈশব থেকে চিকিৎসা শুরু হওয়া। |