দারিদ্রের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছেন এক স্কুলশিক্ষক। জেহাদ চলছে দু’দশকেরও কিছু বেশি সময় ধরে। অতি দরিদ্র কিংবা অনাথ শিশুদের সামান্য থাকা-খাওয়া, লেখাপড়া আর কলরবই এই জেহাদের ভাষা। দারিদ্রের মধ্যেও ‘একটু ভাল’ থাকার আয়োজন।
সুন্দরবনের বিভিন্ন গ্রাম থেকে অতি দরিদ্র পরিবারের শিশু-কিশোরদের মানুষ করার ‘চ্যালেঞ্জ’ নিয়েছেন মহেশপুর যশোদা বিদ্যাপীঠের শিক্ষক অমলকৃষ্ণ পণ্ডিত। সম্বল বলতে পৈতৃক জমিজমা, একটি ছোট-বড় মিলিয়ে গোটা পাঁচেক ঘর আর নিজের মাইনে। এই নিয়েই বর্তমানে ১৯টি শিশু-কিশোরকে বড় করে তুলছেন অকৃতদার অমলবাবু। লোকে তাঁকে ‘মাস্টার’ বলে ডাকে। গত দুই দশকে তাঁর কাছে বড় হয়েছে অনেকেই। তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েক জন এখন তাঁরই মতো হাইস্কুলের শিক্ষক। এমনকী তিনি যে স্কুলে পড়ান, সেই স্কুলেই শিক্ষকতা করছেন তাঁর হাতে বড় হওয়া এক যুবক। পরম তৃপ্তি-মাখানো হাসি নিয়ে জানালেন বছর ৫৬-র অমল ‘মাস্টার’। |
বাসন্তী বাজার থেকে মাইল ছয়েক দূরে মহেশপুর গ্রাম। মাস্টারের ‘আশ্রমে’ ৫ থেকে ১৭ বছরের ১৯টি শিশু-কিশোর। গায়ে সাধারণ জামা-কাপড়, কোথাও বা সামান্য একটু ছেঁড়া। কিন্তু পরিচ্ছন্ন। অমলবাবুর কথায়, “মাস মাইনেই ভরসা। কোনও রকমে চালিয়ে নিতে হয়। তবে সবাই মিলে খুব আনন্দে থাকি।” খাওয়াদাওয়া বলতে ভাত, ডাল, মাছ বা একটা তরকারি। ওই ‘আশ্রমে’রই ছোট একটি পুকুরের মাছ। তাও রোজ নয়। হাসতে হাসতে ‘মাস্টার’ জানালেন, শীতকালে স্কুল যাওয়ার আগে গায়ে সরষের তেল মেখে ওই পুকুরেই বাচ্চাগুলো দাপাদাপি করে।
আশ্রমের খুদে বাসিন্দাদের কারও বাবা জন-মজুরের কাজ করেন। কারও বাবা বেঁচে নেই, কারও বা মা-বাবা কেউই নেই। ওই রকম কোনও শিশুর খবর পেলেই ‘মাস্টার’ ছুটে যান নির্দিষ্ট গ্রামে। তাকে নিয়ে আসেন নিজের কাছে। ইশারায় দু’-তিনজনকে দেখিয়ে কানে কানে ‘মাস্টার’ বললেন, “ওদের বাবা মধু আনতে জঙ্গলে ঢুকেছিল। বাঘের পেটে গিয়েছে। মা ভিক্ষে করেন।” এখন ওই বাচ্চাগুলোর চেহারা গ্রামের আর পাঁচটা নিম্নবিত্ত, কিন্তু খাওয়াপড়ার নিশ্চয়তা রয়েছে এমন ঘরের বাচ্চাদের মতোই। ফেলু-রাখাল-কালোরা প্রত্যেকেই স্কুলে পড়ে। ‘আশ্রমে’র সামনেই প্রাথমিক স্কুল, হাইস্কুল। বিকেলে ওখানেই খেলাধুলো করে ফিরে এসে মুড়ি খেয়ে পড়তে বসে যায়।
বিয়ে-থা না করে কেন এ সব করেন? মাস্টারের সংক্ষিপ্ত জবাব, ‘‘ভালো লাগে।’’ তাঁকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন যিনি, সেই মানুষটিও আর এক মাস্টারমশাই। অমলবাবু বলেন, “তখন ট্যাংরাখালি কলেজে পড়ি। আমাদের কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন সুধীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। স্যারের অনুপ্রেরণাতেই এই পথে হাঁটতে শুরু করেছিলাম।” অবসর নেওয়ার পরে ‘স্যার’ এখন কলকাতায় বিবেকানন্দ রোডে নিজের বাড়িতে চলে গিয়েছেন। কিন্তু নিয়মিত যোগাযোগ এখনও রয়ে গিয়েছে। কী ভাবে চালান এত কিছু? “কষ্টে। তবে খুব কষ্টে নয়, চলে যাচ্ছে। আমার মাইনের টাকা আর কখনও কখনও কিছু দান।” দান মানে, পয়সা-কড়ি নয়। “যেমন ধরুন, বাজারে যাঁরা সব্জি বিক্রি করেন তাঁরা কেউ অনেক সময় সব্জির দাম নেন না।” ১৯৯০ সাল থেকে শুরু করে এই ভাবেই চলছে। একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সাহায্য করতে চেয়েছে। ‘মাস্টার’ রাজি হননি। সরকারি অনুদানের জন্যেও আবেদন করেননি। কেন? দার্শনিক-সুলভ একটি উত্তর ভেসে আসে, “দারিদ্র ভাগ করে নিলেও অনেকের দারিদ্র কিছুটা কমে।” |