মুম্বই এফসি-১ (ফ্রাইডে)
মোহনবাগান-২ (ওডাফা-পেনাল্টি সহ ২) |
গাঁদা ফুল, কলা গাছ লাগানো নতুন টিমবাসের দু’দিকে লাইন দিয়ে উচ্ছ্বসিত ভক্তকুল। মোহনবাগানের ‘ও টু’ ফেরার সময় ভিড়ের মধ্যে ঢেকে গেল বড়সড় শরীরটা।
একটা বাক্যে কী ভাবে ব্যাখ্যা হয় ওডাফা ওকোলির গোলতৃষ্ণা?
সুব্রত ভট্টাচার্য বাড়ি ফিরতে ফিরতে বলেন, “ও হল একটা বোমা”।
প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিক সম্মেলনে এসে বলেন, “ভারতের ফুটবল ওর পকেটে।”
দুটোই খাঁটি পর্যবেক্ষণ। ১৩২ ম্যাচে ১৩৩ গোল হয়ে গেল আই লিগে। ‘ও টু’-র আগে আগে গোল চলে, পিছন পিছন ম্যাচ। স্ট্রাইকিং রেট একের চেয়ে বেশি। শনিবারে দ্বিতীয় গোলটার সময় তিনি বক্সে উঠে এলেন যেন অরণ্যদেবের মতো। কেউ টের পেল না। প্রতিপক্ষ ক্লান্ত হলেই তাঁর ছোবল অনিবার্য। এ দিনও যা হল।
৭৪ মিনিট পর্যন্ত পিছিয়ে থাকা দল যখন ২-১ জেতে, তখন স্বপ্নের প্রাসাদে ঢাকা পড়ে যায় চারপাশের আবর্জনা। স্বপ্নের প্রাসাদটা ওডাফা। প্রাসাদের গেট হল সুব্রতর মণীশ ভার্গবকে নামানোর চাল। মোহনবাগানের দু’নম্বরে ওঠার ম্যাচে অবশ্য আবর্জনাই বেশি। ‘ও টু’ময় ম্যাচে অধিকাংশ পর্যবেক্ষণে ‘সিও টু’ই বেশি। অক্সিজেন নয়, কার্বন ডাই অক্সাইড। কোচ অবশ্য বলছেন, “আমার এখন ভাল খেলার থেকেও দরকার তিন পয়েন্ট।”
গেমমেকারের খোঁজে: শেষ ১৬ মিনিট বাদে ওডাফাকে মাঝমাঠ বল দিল দুটো। এক বার নিজেদের বক্সের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে চকিত হেডে গোল করেই ফেলেছিলেন প্রায়। মুম্বই এফসি-র বিরুদ্ধেও ঘরের মাঠে দু’জন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার (রাকেশ, ড্যানিয়েল) নিয়ে নামার যুক্তি একটাই হতে পারে। বিকল্প পাসার কোথায়? সুরকুমার ওভারল্যাপে গেলেই শুধু গোলের রাস্তা দেখা যাচ্ছিল। |
যন্ত্রণার নাম পাসিং: টেনিসে আনফোর্সড এররের মতো প্রচুর ভুল পাস হল। প্রথম মিনিটে অজস্র পাস খেলেও ওডাফার সতীর্থদের পাসিং নিয়ে আত্মবিশ্বাস ফুটে উঠল না। লং পাসগুলো হচ্ছিল শুধু ওডাফাকে লক্ষ করে। অধিকাংশই পৌঁছয়নি।
কবে বড় হবেন ভাইরা: মেহতাব ও নবির পরে এখন বাংলায় সেরা সম্ভাবনা বজবজের জুয়েল রাজা। সোদপুরের স্নেহাশিসের খেলার স্টাইলটা একই রকম থেকে গেল। অনেক দিন ছোট্টটি থাকলেন, এ বার বড় হন। দলে তারকারা নেই, এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নায়ক হতে ব্যর্থ দু’জনে। জুয়েল প্রথমে খেলছিলেন উইংয়ে। রীতিমতো অস্বচ্ছন্দ। মণীশ নামায় তিনি মাঝমাঠের ভেতরে ঢুকলেন। কিছুটা খুঁজে পেলেন নিজেকে। পেনাল্টিও তাঁর জন্য। ফাউল করেছিলেন ধনচন্দ্র।
টিনএজার-দাপট: যে দলটার বেঞ্চে দু’জন অনূর্ধ্ব ১৯, তাদের রিজার্ভ বেঞ্চে কেমন কান্নাকাটির দশা লেখার দরকার নেই। মোহনরাজ পারছেন না দেখে বড় দ্রুত সাইডব্যাক বদলাতে এল। তখন নামলেন অনূর্ধ্ব ১৯ দীপক। অনেক পরের দিকে, ৬৩ মিনিটে মণীশ ভার্গব। মিডফিল্ডার ছেলেটি নামতে সুব্রত-বাগানে গতি ও প্রাণ এল। ওডাফার সঙ্গী অসীমকে ক্লান্ত লাগছিল। মণীশ ছবিটা পাল্টালেন, স্টাইলও।
স্ট্রাইকার যখন স্টপার: সুনীল ছেত্রী আসার আগে তিনিই ছিলেন জাতীয় দলে ভাইচুংয়ের সঙ্গী। ২০০২ থেকে খেলছেন ভারতের হয়ে। এল জি কাপ ফাইনালে ভারতের জয়ের গোল তাঁরই। সেই অভিষেক যাদব এ দিন স্টপারে খেলে থামাচ্ছিলেন ওডাফাকে। ওডাফা একা থাকায় সুবিধে হয়ে যাচ্ছিল। “শেষ তিনটে ম্যাচে স্টপারে খেলছি বিকল্প নেই বলে। কিন্তু ভাল খেলে লাভ কী হল?” ফেরার সময় বিষণ্ণ গলা অভিষেকের। ৭৪ থেকে ৮১ সাত মিনিটে ওডাফার গোল দুটো না হলে অভিষেকই ম্যাচের সেরা হতেন। |
জুটির উত্থান-পতন: কিংশুক মরসুমের অন্যতম ধারাবাহিক। আনোয়ার শেষ দুটো ম্যাচে অসম্ভব উন্নতি করেছেন। তবু শনিবার ফ্রাইডে ১-০ করলেন দুই স্টপারের মাঝ দিয়ে। তাঁরা সমান্তরাল দাঁড়িয়ে তখন। পরে বহুবার বিব্রত করলেন লালমরা। বাগানের দুই স্টপার পাপস্খালন করলেন ২-১এর সময়। কিংশুকের লম্বা ফ্রি কিকে আনোয়ারের হেড। ওই সময়ই ওডাফার পি সি সরকার হয়ে আবির্ভাব। মাটি ফুঁড়ে, গিলিগিলিগে!
দুই কিপারের দুই ছবি: মুম্বই এফসি-র বাঙালি কিপার সঞ্জীবন ঘোষকে সংগ্রাম মুখোপাধ্যায় প্রথম দেখলেন টানেলে, মাঠে নামার সময়। তখনই কথা বলে জানেন ছেলেটি আন্দুলের। সঞ্জীবনকে সংগ্রাম টিপস দিতে পারেন, কী ভাবে মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। শেষ দিকে টেনশনে একটা বড় ভূল করলেন সঞ্জীবন। আনোয়ারের হেড ফসকালেন। ওডাফারা একটা ভুলের অপেক্ষায় থাকেন। একটাতেই গোল। ও দিকে সংগ্রাম কেভিন লোবোর একটা দুরন্ত শট দুরন্ত হয়ে বাঁচালেন। নইলে তখন ২-০ অবধারিত। ওডাফা, কিংশুক, নবি ছাড়া ধারাবাহিকতায় সুব্রতর এই দলে থাকবেন সংগ্রাম। “আগের থেকে ডিফেন্স অনেক জমাট। তাই আমি আত্মবিশ্বাসী বেশি।” বলছিলেন তিনি।
এত তথ্যের পরেও মোহনবাগান কোচের একটা মন্তব্য সবচেয়ে ইঙ্গিতময়। ঘরের মাঠেও ৭৪ মিনিট পিছিয়ে থাকতে হল কেন? বাইরে জয়ধ্বনি, উৎসব চলছে জনতার। প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্নটা শেষ না হতেই বলে গেলেন, “ফুটবল খেলাটা ৯০ মিনিটের। ৭৪ মিনিটের নয়।”
‘ও টু’ জানেন, কখন ঝাঁপাতে হয়, অক্সিজেন নিতে হয়। ১৬ মিনিটই তাঁর যথেষ্ট। ১৬ মিনিট... ১৬ মিনিট কোথায়? শনিবার তো আসলে যুদ্ধ জিততে ৭ মিনিট লাগল ওডাফার!
মোহনবাগানে খেলেন: সংগ্রাম, সুরকুমার, আনোয়ার, কিংশুক, মোহনরাজ (দীপককুমার), ড্যানিয়েল (প্রদীপ), রাকেশ, জুয়েল, স্নেহাশিস, অসীম (মণীশ), ওডাফা। |