টেলিকম শিল্পে লগ্নিকারীদের আস্থা ফেরাতে এ বার আসরে নামলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ।
সুপ্রিম কোর্ট গত সপ্তাহে এ রাজার আমলের ১২২টি টুজি স্পেকট্রাম ও লাইসেন্সের বণ্টন বাতিল করে ও সরকারকে নিলাম করার নির্দেশ দেওয়ার পর থেকেই টেলিকম ক্ষেত্রে নিজেদের বিনিয়োগ নিয়ে আশঙ্কায় ভুগছেন লগ্নিকারীরা। বেশ কিছু সংস্থা ইতিমধ্যেই তাদের দুশ্চিন্তার কথা সরকারের বিভিন্ন মহলের কাছে জানিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে লগ্নিকারীদের ভরসা যাতে ধাক্কা না খায়, তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তে টেলিকম শিল্পের ভবিষ্যৎ রূপরেখা কী হবে, তা নিয়ে আজ বৈঠকে বসেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়, টেলিকমমন্ত্রী কপিল সিব্বল, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম, অ্যাটর্নি জেনারেল গুলাম বাহনবতী ও টেলিকমসচিব আর চন্দ্রশেখর।
বস্তুত, সুপ্রিম কোর্ট টুজি লাইসেন্স বাতিলের নির্দেশ দেওয়ার পরে টেলিকম দফতর ডট-ও এখন সমস্যায়। তাদের সামনে একাধিক প্রশ্ন। কিন্তু জবাব জানা নেই। যেমন, ডট জানে না, ২০০১-২০০৭ সালের মধ্যে দেওয়া ৭৩টি লাইসেন্সের উপরে এই রায়ের কী প্রভাব পড়বে? সুপ্রিম কোর্ট ‘আগে এলে আগে সুযোগ’ নীতিটাকেই মূলগত ভাবে ভুল বলে ২০০৮ সালে দেওয়া ১২২টি লাইসেন্সকে বাতিল করেছে। অথচ, এই নীতিতে ২০০১ সাল থেকে লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। তা হলে সেই লাইসেন্সগুলির কী হবে? ডট জানে না, আইডিয়া এবং এস টেলের যে সব সার্কেলে টুজি লাইসেন্স বাতিল হয়েছে, সেখানে তাদের ৩জি লাইসেন্সের কী হবে। সংস্থাগুলির কাছ থেকে যে লাইসেন্স ফি বাবদ ৯৫০০ কোটি টাকা এবং অতিরিক্ত ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি সংগ্রহ করা হয়েছে, তারই বা কী হবে? তা কি ফেরত দেওয়া হবে? সর্বোপরি, একই সঙ্গে জিএসএম এবং সিডিএমএ প্রযুক্তির জন্য দেওয়া ৩৭টি লাইসেন্সের কী হবে? নিরুপায় ডট বিশেষ করে লাইসেন্স ফি ও গ্যারান্টি ফেরত দেওয়া হবে কি না, তাই নিয়ে আইনি পথ খতিয়ে দেখার কথা ভাবছে। |
এখন প্রশ্ন |
• ২০০১ থেকে ’০৭-এর মধ্যে দেওয়া ৭৩টি টুজি লাইসেন্সের উপরে রায়ের প্রভাব পড়বে কি?
• বাতিল ১২২টি সংস্থাকে কি লাইসেন্স ফি ও ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি ফেরত দেওয়া হবে?
• একই সঙ্গে জিএসএম এবং সিডিএমএ প্রযুক্তির জন্য দেওয়া ৩৭টি লাইসেন্সের কী হবে?
• বাতিল হওয়া ক্ষেত্রে একই সংস্থার থ্রিজি লাইসেন্সের ভবিষ্যৎ কী? |
|
টুজি-র বিরাট বাজার ঘিরে যে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ হয়েছে, তা নিয়ে এখন ঘোর অনিশ্চয়তা। সেই অনিশ্চয়তা কাটাতে ডট-কে এমনই বহু প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হচ্ছে। একই ভাবে টেলিকম শিল্পের ভবিষ্যতের দিশা খুঁজতে এ দিন বৈঠক করলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহও। দিশা খোঁজার পাশাপাশি এই বৈঠকে বাতিল লাইসেন্সগুলির নিলাম কী ভাবে হবে, তা নিয়েও প্রাথমিক পর্যায়ের আলোচনা হয়। ইতিমধ্যেই বাতিল লাইসেন্সগুলির নিলাম পদ্ধতি নির্ধারণ করতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকেই নোটিস পাঠিয়েছে টেলিকম নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ট্রাই। সেই নোটিসের ভিত্তিতেই নিলামের ক্ষেত্রে কী মাপকাঠি থাকবে, তা নিয়ে এক দফা আলোচনা হয় ওই বৈঠকে। সব মহলের কাছ থেকে আগামী চার দিনের মধ্যে (অর্থাৎ, ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে) ওই নোটিসের উত্তর চাওয়া হয়েছে। সেই উত্তর দেখার পরেই এ বিষয়ে এগোনোর কথা ভাবছে মন্ত্রক। আগামী দিনে নিলামে স্বচ্ছতা যাতে থাকে, তার জন্য সমস্ত আইনি দিক খতিয়ে দেখে এগোতে বলা হয়েছে মন্ত্রককে। কেন না, ফের টুজি নিলাম নিয়ে কোনও বিতর্ক তৈরি হোক, তা মোটেই কাম্য নয় সরকারের কাছে।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করা হবে কি না, সে বিষয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। যদিও কপিল সিব্বল বৈঠক শেষে বলেন, “সুপ্রিম কোর্ট টুজি নিয়ে কী আদেশ দিয়েছে, তা আজ প্রধানমন্ত্রী-সহ সরকারের অন্য শীর্ষ মন্ত্রীদের জানানো হয়েছে।” কিন্তু মন্ত্রক জানিয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের বিরুদ্ধে সরকার কোনও পদক্ষেপ করবে কি না, তা নিয়েও এক দফা আলোচনা হয়। কেন না, কংগ্রেস তথা সরকারের একটি বড় অংশ এখনও মনে করে, আদালত যতই ‘একতরফা’ বা ‘সংবিধান বহির্ভূত’ বলুক না কেন, স্পেকট্রাম বণ্টনের ক্ষেত্রে নীতিতে কোনও ভুল ছিল না। তা ছাড়া যে ভাবে দেশের সর্ব্বোচ্চ আদালত নিজের এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে স্পেকট্রাম নিলামের ক্ষেত্রে চার মাসের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে, তা-ও ভাল ভাবে নেয়নি কংগ্রেসের একাংশ। এই কারণে রায় পুনর্বিবেচনা হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছে সরকারের একাংশ। শুধু সরকারই নয়, গত ২ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের ওই নির্দেশ আসার পরে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু সংস্থা ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইনি পথে হাঁটার কথা চিন্তাভাবনা করছে। নরওয়ের সংস্থা টেলিনরের স্বার্থরক্ষায় কপিল সিব্বলের সঙ্গে দেখা করেছেন সে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রীও। টেলিকম মন্ত্রক সূত্রের খবর, সুপ্রিম কোর্ট যে লাইসেন্স বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার বিভিন্ন আইনি দিকগুলি ও ফলাফল কী হতে পারে, তা আজকের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হয়।
লগ্নিকারীদের ভবিষ্যৎ যাতে সুরক্ষিত থাকে, আজকের বৈঠকে সে বিষয়টির উপর জোর দিতেও পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সমীক্ষা বলছে, একশো কুড়ি কোটির এই দেশে মাত্র ৯ কোটি মানুষ মোবাইল ব্যবহার করেন। অব্যবহৃত বিরাট বাজার তাই স্বাভাবিক ভাবেই লগ্নিকারীদের কাছে আকর্ষণীয়। কিন্তু সর্ব্বোচ্চ আদালতের রায়ের পরে এই শিল্পে বিদেশি বিনিয়োগ আসা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আশঙ্কা রয়েছে, নিলামে ‘লড়াই করতে’ না পেরে অনেক সংস্থাই ব্যবসা গুটিয়ে চলে যেতে পারে। বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দার মধ্যে দেশীয় বাজার থেকে বিদেশি বিনিয়োগ চলে যাক, তা চান না মনমোহন। গত কালই ইউনিনর টুজি লাইসেন্স নিলামের ক্ষেত্রে ন্যূনতম দর ২০০৮ সালের নির্ধারিত ১৬৫৮ কোটি টাকায় বেঁধে দেওয়ার জন্য টেলিকম মন্ত্রকের কাছে আবেদন জানিয়েছে। পাশাপাশি তারা এ-ও দাবি করেছে, যে সব সংস্থার কাছে টুজি স্পেকট্রাম ও লাইসেন্স রয়েছে, তাদের যেন নিলামে অংশ না নিতে দেওয়া হয়। দাবি না মানা হলে প্রয়োজনে চরম পদক্ষেপ করতে পারে ওই সংস্থা, এই আশঙ্কা রয়েছে টেলিকম মহলে। এই পরিস্থিতিতে যাতে লগ্নিকারীদের আস্থা ধরে রাখা যায়, তার জন্য পদক্ষেপ করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। টেলিকম মন্ত্রকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সরকার এমন পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে চাইছে, যাতে সব পক্ষকেই সমান সুবিধা দেওয়া যাবে।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিষয়টি মাথায় রেখে বাতিল হওয়া ১২২টি লাইসেন্স যাতে ২ জুনের মধ্যে নিলাম করা যায়, তার জন্যও সক্রিয় হয়েছে মন্ত্রক। আদালত আগামী চার মাস নতুন মোবাইল সংস্থাগুলিকে পরিষেবা চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিলেও মন্ত্রক এখন দ্রুত ওই লাইসেন্স ও স্পেকট্রাম ফেরত পেতে চাইছে। মন্ত্রকের বক্তব্য, বাতিল হওয়া লাইসেন্স ও স্পেকট্রাম হাতে না পাওয়া পর্যন্ত নিলামের কাজ শুরু করা সম্ভব হবে না। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে সংস্থাগুলিকে কী ভাবে রাজি করানো সম্ভব হয়, সেই রাস্তাই এখন খুঁজতে ব্যস্ত মন্ত্রক। |